উলূমুল কোরআন (নোটবুক)

উলূমুল কোরআন (নোটবুক)

উপস্থাপনাঃ-

    বিজ্ঞানময় আল-কোরআন মানবজাতির মুক্তিরসনদ। এটা সর্বকালের ও সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশীগ্রন্থ। এতে মানবজীবনের মৌলিক সমস্যাগুলোর প্রকৃত সমাধান পেশ করা হয়েছে। তা ছাড়া জাগতিক সকল সৃষ্টির বিজ্ঞানভিত্তিক বর্ণনা রয়েছে এই কুরআনে ।আর উক্ত কুরআনকে সহজে উপলব্ধি করার জন্য এবং ক্রমান্বয়ে অধ্যয়ন করার সুবিধার্থে সুরা এবং আয়াতে বিভক্ত করে দিয়েছেন। যার ফলে মানুষ সহজে কোরআন অধ্যয়ন করে তা অনুধাবন করতে পারে। এবং বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। এ সকল কারনেই এ পৃথিবীতে আল-কোরআন সর্বাধিক পঠিত ও গবেষণার উৎস। অন্যান্য আসমানী কিতাবের ন্যায় মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কোরআন একেবারেই নাযিল হয়নি,বরং মহানবী (সঃ) এর নবুয়তি জীবনের সুদীর্ঘ তেইশ বছরে প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে জিব্রাইল আমীনের মারফতে ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ন করেন। এ প্রক্রিয়ায় কোরআন অবতীর্ন হওয়ার মাঝে নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর অপার হেকমত নিহিত ছিল। সুতরাং কুরআনের উপর আমলকারীদের এর সুরা বা আয়াত অবতীর্নের কারন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন,যা থেকে বহুবিধ উপকারীতা লাভ করা যায়। এই কুরআন যেহেতু আরবী ভাষা-ভাষীদের উপর নাযিল হয় তাই তাতে যবর যের ইত্যাদি ছিল না। পরবর্তীতে অনারবদের পড়ার ও বুঝার সুবিধার্থে যবর-যের ইত্যাদি সংযোগ করে আমাদের জন্য আরো নেয়ামতপুর্ণ করে তোলা হয়। নিন্মে আল-কুরআনের বিষয়ে বিস্তারীত আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

আল-কোরআনের শাব্দিক পরিচয়ঃ-

           কুরান-এর শাব্দিক বিশ্লেষণ নিয়ে আলেমদের মতবিরোধ রয়েছে। যেমনঃ-

১। ইমাম শাফেয়ী ও একদল আলেমের মতে-'কুরআন' হল নির্ধারিত নাম।এটা এসমে মুশতাক বা অনির্ধারিত নাম নয়। তাঁরা বলেন এটা কালামুল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট নাম। যেমন ইঞ্জিল, তাওরাত, যবুর বিশেষ কিতাবের নাম ছিল। অনুরুপ সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থের নাম হল কুরআন; আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-"বরং এটা মহান কোরআন

লওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ।"(বুরুজ ২১-২২)

২। আরেক দল আলেম বলেন,'কুরআন' শব্দটি অনির্দিষ্ট নাম। যার অর্থ মিলিত অর্থাৎ একটি অপরটির সাথে মিলিত। আর যেহেতু পবিত্র কুরআনের এক আয়াত অপর আয়াতের সাথে মিলিত তাই এটাকে 'কুরআন' বলা হয়।

৩। কিছু সংখ্যক আলেমের মতে, 'কুরআন' শব্দটি 'ক্বারউন' হতে নির্গত। এসমে মাফউল থেকে এর অর্থ হবে পঠিত। পবিত্র কুরআনকে এজন্যই কুরআন বলা হয় যেহেতু এটা পৃথিবীতে সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ।

৪। অনেকে বলেছেন, 'কুরআন' শব্দটির অর্থ অধিক নিকটতর। যেহেতু কুরআনের পাঠ, পঠন ও তদানুযায়ী আমলকারীকে আল্লাহর নিকট পৌঁছে দেয়। তাই কুরআনকে 'কুরআন' নামকরন করা হয়েছে।

৫। ইমাম রাগেব ইসফাহনী (রহঃ) বলেছেন 'কুরআন' এর অর্থ হল একত্র করা, জমা করা। কোন বিষয় অধ্যয়ন ও পাঠ করার জন্যে প্রচুর অক্ষর এবং শব্দসম্ভার একত্র করতে হয়; এই ন্যুনতম সামঞ্জস্যের ভিত্তিতে পরবর্তী পর্যায়ে 'কুরআন' শব্দটি অধ্যয়ন করা , পাঠ করা'র অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

আল-কুরআনের পারিভাষিক পরিচয়ঃ-

        ১। নুরুল আনোয়ার গ্রন্থকার বলেন-কুরআন হল রাসুল(সঃ)-এর উপর অবতারিত যা সহীফাসমুহে লিপিবদ্ধ আছে, যা রাসুল(সঃ) থেকে সন্দেহমুক্ত প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিকভাবে উদ্ধৃত হয়ে এসেছে।

২। মুজামুল ওয়াসীত গ্রন্থে বলা হয়েছে-কুরআন হল আল্লাহর কালাম বা কথা যা তিনি তাঁর রাসুল(সঃ) এর উপর অবতীর্ণ করেছেন, যা সহীফাসমুহে লিপিবদ্ধ আছে।

৩। আল্লামা মুফতী আমীমুল ইহসান(রঃ) বলেন-কুরআন হল এমন এক আসমানী কিতাব যা আমাদের মহান নেতা মুহাম্মদ (সঃ) এর উপর অবতীর্ণ, যার একটি সূরার মোকাবিলায় মানুষ অক্ষম।

আল-কুরআনকে কেন কোরআন নামকরন করা হয়েছেঃ-

            কি তাৎপর্য ও সাদৃশ্যের ভিত্তিতে পবিত্র এই গ্রন্থের নাম "আল-কোরআন" হয়েছে; মূল  গ্রন্থের সাথে এ নামের সামঞ্জস্য কি; এ সম্পর্কে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন তথ্য ও মত প্রকাশ করেছেন। তন্মধ্যে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য অভিমত হচ্ছে কোরআন অবতীর্ন কালে মক্কার অধিবাসীরা পবিত্র গ্রন্থের বানীসমুহ শ্রবন করতোনা। কোরআন তেলাওয়াতের সময় নানারুপ গোলযোগ করে এতে বাঁধা সৃষ্টি করতো। আর এই হীন আচরনে অন্যদেরকেও উৎসাহিত করতো। হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেন,স্বয়ং আবু জেহেল নিজেই লোকদেরকে এই কাজের জন্য প্রস্তুত করে নিয়েছিল। সে বলেছিল,'মুহাম্মদ যখন কোরআন তেলাওয়াত করেন তখন তোমরা তার সম্মুখে হট্রগোল, চিৎকার গোলযোগ করো, যাতে তিনি কি পাঠ করছেন লোকেরা তা বুঝতে না পারে।' ফলে সত্যি সত্যিই তারা এই অদ্ভুত আচরন করতো। এমনকি নানারুপ অশ্লীল সংগীত ও বিকৃত কবিতা আবৃত্তি করে কোরআন শ্রবণে বাঁধা সৃষ্টি করতো। বস্তুতঃ তদানীন্তন কাফেরদের এই হীন আচরন ও অশ্লীল ব্যবহারের জবাবে "আল-কোরআন" নাম রেখে এদিকে ইংগিত করা হচ্ছে যে, এসব কুৎসিৎ আচরণ দ্বারা কোরআনের সুমহান দাওয়াত ও বুলন্দ আওয়াজকে কিছুতেই রোধ করা যাবে না। পবিত্র এই গ্রন্থ পঠিত হওয়ার জন্যই নাযিল হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা পঠিত হতেই থাকবে। সুতরাং এ কথা এখন কাফের মুসলিম নির্বিশেষে সর্বজন স্বীকৃত সত্য যে, সারা বিশ্বে একমাত্র কোরআনই সর্বাপেক্ষা অধিক পঠিত ও পাঠিতব্য গ্রন্থ।

আল-কোরআনে বর্নিত কোরআনের নাম সমুহঃ-

      পবিত্র কোরআনেই এর বিভিন্ন নাম উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লামা সুয়ুতী(রঃ) তাঁর রচিত গ্রন্থ "আল-ইতকান ফি উলুমুল কুরআন"-এ ৫৫টি নাম বর্ণনা করেছেন, তা হল.........

১। আল-কোরআনঃ এটা উক্ত গ্রন্থের নির্দিষ্ট নাম। যেহেতু এটা অধিক পঠিত গ্রন্থ, বিধায় এটাকে 'কুরআন' নামকরন করা হয়েছে।(বুরুজ-২১,২২)

২। আল-কিতাবঃ যেহেতু এর মধ্যে সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ঘটনাবলি এবং সঠিক সংবাদ উত্তমরুপে একত্রিত করা হয়েছে তাই একে 'কিতাব' বলা হয়।(বাকারা-০২)

৩। আল-মুবীনঃ মুবীন অর্থ স্পষ্ট, যা বাতিল থেকে হক এবং সত্যকে প্রকাশ করে।এ জন্য কুরআনকে 'মুবীন' বলা হয়।

৪। আল-কারীমঃ এটা আসমান এবং জমীনের মর্যাদাবান বা সম্মানিত গ্রন্থ, তাই একে 'কারীম' নামকরণ করা হয়েছে।

৫। আল-ফুরকানঃ কেননা কুরআন সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী। তাই 'ফুরকান' বলা হয়।

৬। আল-হাকীমঃ যেহেতু এটা গভীর অর্থদায়ক ও বিজ্ঞানময়,তাই 'হাকীম' বলা হয়।

৭। আল-কালামঃ  যেহেতু কুরআন আল্লাহর বানী তাই একে 'কালাম' বলা হয়।

৮। আল-মাওয়েঝাতুঃ যেহেতু এটা মানবজাতির জন্য নসীহত স্বরুপ, তাই 'মাওয়েঝাত' বলা হয়।

৯। আন-নূরঃ কেননা  এটা দ্বারা হালাল হারামের অন্ধকার দূর হয়, তাই 'আন্নুর' বলা হয়।

১০। আল-মুহাইমেনুঃ কেননা এটা পুর্ববর্তী কিতাব ও জাতির ঘটনাবলি সংরক্ষন করে,তাই 'মুহাইমেনু' বলা হয়।

১১। আত্ব-তাযকিরাতুঃ এটা বহুল উপদেশ সম্বলিত গ্রন্থ। তাই 'তাযকিরাত' বলা হয়।

১২। আশ্-শিফাঃ কারন এটা মানুষের শারীরিক ও আত্নিক রোগ উপশমকারী।

১৩। আল-হুদাঃ যেহেতু এটা মানবজাতির জন্য হেদায়াত স্বরুপ।

১৪। আর্-রাহমাতুঃ এটা মানবজাতির জন্য রহমত স্বরুপ।

১৫। আল-আজাবঃ কেননা এটা সার্বিক বিবেচনায় এক বিস্ময়কর গ্রন্থ।

১৬। আল-ওহীঃ কুরআন আল্লাহর প্রত্যাদেশ, তাই 'ওহী' বলা হয়।

১৭। আর-রুহুঃ কেননা কুরআন হৃদয় ও আত্নাকে পুনর্জীবিত করে।

১৮। আল-মাজীদঃ যেহেতু এটা অত্যন্ত মর্যাদাশীল বা সম্মাণিত কিতাব।

১৯। যিকরঃ কেননা এতে অনেক উপদেশ এবং পূর্ববর্তী উম্মতের ঘটনার আলোচনা বিদ্যমান।

২০। আল-মুবারাকঃ পবিত্র কুরআন মানবজাতির জন্য বরকতময় গ্রন্থ।

২১। আল-আ'লীইয়ুঃ কেননা এর মর্যাদা সুমহান।

২২। আল-হিকমাতঃ কেননা এটা অগাধ হেকমত বা প্রজ্ঞায় পরিপুর্ন।

২৩। সিরাতুল মুস্তাকীমঃ কারন এটা বেহেস্তের পথ প্রদর্শন করে যার মধ্যে কোন বক্রতা নেই।

২৪। হাবলুল্লাহঃ কেননা উক্ত কোরআন যে আঁকড়ে ধরবে সে জান্নাতে যাবে।

২৫। আল-আরাবীঃ কেননা এটা আরবি ভাষায় অবতীর্ন হয়েছে।

২৬। আল-ক্বাইয়েমুঃ যেহেতু এটা সুদৃঢ ও চিরস্থায়ী বাণী।

২৭। আল-ক্বাওলুঃ কেননা এটা  আল্লাহর বাণী।

২৮। আল-ফাসলুঃ এ কুরআন সত্য ও অসত্যের মাঝে পার্থক্যকারী বাণী।

২৯। আন-নাবাউলআযীমঃ যেহেতু এটা পুনরুত্থানের সংবাদ প্রদান করে।

৩০। আহসানুল হাদীছঃ কেননা কুরআন সর্বোত্তম বাণী।

৩১। আল মাছানীঃ যেহেতু এর মধ্যে বিভিন্ন ঘটনা ও উপদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে, তাই 'মাছানী' বলা হয়।

৩২। আল-মুতাশাবিহাঃ যেহেতু তার এক আয়াত অপর আয়াতের সাদৃশ্য তাই 'মুতাশাবিহা' বলা হয়।

৩৩। আত্ব-তানযীলঃ কেননা কুরআন প্রয়োজনানুসারে ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হয়েছে।

৩৪। আল-বাছায়েরঃ কারন রটা জ্ঞান ভান্ডারে পরিপুর্ণ।

৩৫। আল-বায়ানঃ যেহেতু কুরআনে সবকিছুর বর্ননা রয়েছে।

৩৬। আল-ঈলমুঃ কেননা এটা সকল জ্ঞানের উৎস।

৩৭। আল-হাক্কুঃ কেননা এটা সত্য ও ন্যায়ের বাহক।

৩৮। আল-হাদীঃ কারন এটা জান্নাতের পথ দেখায়।

৩৯। আল-মুসাদ্দেকুঃ কেননা এটা পূর্ববর্তী সকল কিতাবকে সত্যায়ন করে।

৪০। আল উরওয়াতুল উছক্বাঃ কেননা এটা মুক্তির একমাত্র অবলম্বন।

৪১। আস-সিদ্বক্বুঃ কারন কুরআন অকাট্য সত্য বাণী।

৪২। আল-আদলঃ কেননা এটা ন্যায়পরায়ণাতার কথা বলে।

৪৩। আল-আ'মরুঃ কেননা এটা আল্লাহর আদেশের পান্ডুলিপি।

৪৪। আল-মুনাদাঃ কারন এটা মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে।

৪৫। বুশরাঃ কেননা এটা পরলৌকিক মুক্তির সুসংবাদ প্রদান করে।

৪৬। আয-যাবুরঃ কেননা তা অন্যান্য কিতাবের মত।

৪৭। আল-বাশীরঃ কারন এটা জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করে।

৪৮। আন-নাযীরঃ এ কুরআন জাহান্নামের দুঃসংবাদ প্রদান করে।

৪৯। আল-আযীযুঃ কেননা কুরআনের বিরোধীর জন্য এটা প্রবল পরাক্রমশালী।

৫০। আল-বালাগুঃ কেননা এটা তৌহিদের বানী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়।

৫১। আহসানুল ক্বাসাসঃ কেননা কুরআনের বর্ণিত ঘটনাসমুহ সত্য, সুন্দর ও বিশুদ্ধ।

৫২। আল-মাছহাফঃ যেহেতু এ গ্রন্থ মাসহাফে লিখিত।

৫৩। আল-মুকাররামাতঃ কারন কুরআন অতি সম্মাণিত গ্রন্থ।

৫৪। আল-মারফুয়াতঃ কেননা এ গ্রন্থ উন্নত মর্যাদার অধিকারী।

৫৫। আল-মুত্বাহহারাতঃ এটা পুতঃপবিত্র কিতাব। তাই একে 'মুত্বাহহারাত' বলা হয়।

 

আল-কোরআনের আলোচ্য বিষয় কিঃ-

       আল-কোরআনের  মূল আলোচ্য বিষয় মানব জাতি। কি তাদের কল্যাণ আর কিসে তাদের অকল্যাণ হয় পবিত্র কোরআনে তারই পরিচয় দান করা হয়েছে। বিষয়বস্তুর দিক হতে পুরো আল-কোরআনকে যে ভাবে ভাগ করা যায় তা নিন্মে দেয়া হলো-

ক) তাওহীদ বা আল্লাহর পরিচয়।

খ) রিসালাত বা নবী রাসূলদের পরচয়।

গ) আখিরাত বা তার পরিচয়।

ঘ) কিতাবুল্লাহর গুরুত্ব ও মর্যাদা ইত্যাদি।

হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রাঃ) তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ফওযুল কবিরে কোরআনের আলোচ্য বিষয়গুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন।

১। ইলমুল আহকাম বা সাংবিধানিক জ্ঞানঃ ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সকল প্রকার বিধি নিষেধ এবং ফরজ, ওয়াজিব, হালাল, হারামসহ যাবতীয় আদেশ-নিষেধ এর আওতাভুক্ত।

২। ইলমুল মুখাদামা বা ন্যায়শাস্ত্রঃ ইয়াহুদ, নাছারা, মুশরিক ও মুনাফিক এই চার দলের ভ্রান্ত মতবাদ সংক্রান্ত।

৩। ইলমুল তাযকীর বা স্রষ্টাতত্বঃ  তাওহীদ বা একত্ববাদের সকল প্রকার আলোচনা।

৪। সৃষ্টিতত্বঃ আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুর অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা।

৫। পরকাল জ্ঞানঃ আখেরাত বা পরকাল সংক্রান্ত শাস্তি পুরস্কারসহ সকল আলোচনা।

  আল-কোরআন নাযিলের উদ্দেশ্য কিঃ-

       পবিত্র কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্যাবলি নিম্নরুপঃ-

১। সমস্যার সমাধানঃ মানবতার সকল সমস্যার সমাধান কল্পে আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়।

২। হেদায়াতের আলোকবর্তিকাঃ বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াত, রহমত ও সুসংবাদের ঘোষনা এবং দিশেহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দানের নিমিত্তে আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআন অবতীর্ন করেন।

৩। তাযকিয়ায়ে নফসঃ আত্নার পরিশুদ্ধি সাধনের লক্ষে আল-কুরআন অবতীর্ন হয়।

৪। ভ্রান্ত বিশ্বাস অপনোধনঃ  তৎকালীন আরব সমাজের লোকেরা বিভিন্ন ভ্রান্ত আকীদা পোষণ করত। নিজেদের  মনমত বিধান তৈরী করে জীবন অতিবাহিত করত। তারা ছিল চরম কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। তাদের সে ভ্রান্ত আকীদাসমূহ খন্ডনের নিমিত্তে কুরআন অবতীর্ন হয়।

৫। ইসলামী সমাজের রুপরেখা প্রধানঃ ইসলামী সমাজের একটি বাস্তব রুপরেখা প্রধান করে মানব রচিত সকল মতাদর্শ উৎখাত করে আল-কুরআনের রাজ কায়েম করা। বস্তুত এটাই ছিল কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য।

৬। সত্যায়নকারী রুপেঃ আল-কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানী কিতাব। এর পুর্বে অনেক আসমানী কিতাব নিয়ে অগণিত নবী ও রাসূল আগমণ করেছেন।সর্বশেষ কুরআন এসে পূর্ববর্তী নবী রাসূল ও তাদেরকে প্রদত্ত আসমানী কিতাবের সত্যতা প্রমাণ করেছে।

৭। শিরক মুক্ত সমাজ বিনির্মাণঃ আল-কুরআন নাযিলের পুর্বে মানবতা ছিল জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশায় আচ্ছন্ন। শিরক, কুফর আর নিফাকীতে ছেয়ে গিয়েছিল মানব সমাজ। কুরআন এসে বিশ্ববাসীকে শিরক,কুফর ও নেফাকী থেকে মুক্ত করে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির পথ-নির্দেশ প্রদান করে।

৮। ইনসাফ কায়েমঃ বিশ্ব মানবতা শান্তি চায়। আর এ জন্য দরকার ন্যায় ও ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়া। কুরআন নাযিলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।

৯। প্রতিপালকের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টিঃ প্রতিটি মুমিনেরই একান্ত কামনা থাকে তার মনিবের সাথে সাক্ষাত লাভ।আর আল-কুরআন এ কামনা পূরনে পথনির্দেশ হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। এর অসংখ্য আয়াতে প্রতিপালকের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির প্রয়োজনীয় হেদায়াত ও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

১০। সতর্কতা  প্রদানের নিমিত্তেঃ পবিত্র কুরআন আল্লাহ প্রদত্ত সকল নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য অবতীর্ন হয়েছে। পাশাপাশি অতীতের হটকারী জাতিগুলোর শোচণীয় পরিণামসমুহ উল্লেখের মাধ্যমের মানবসমাজকে সতর্কতা প্রদানের নিমিত্তে আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়।

আল-কোরআন নাযিলের ইতিহাসঃ-

           কুরআনুল কারীম আল্লাহর সংরক্ষিত দপ্তর লাওহে মাহফুযে সংরক্ষিত ছিল এবং বর্তমানেও আছে। যেমন আল্লাহ ইরশাদ করেন"

বরং এটা মহান কোরআন,লওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ।"(বুরুজ-২১,২২) এই কুরআন আমাদের নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এর উপর প্রয়োজন অনুযায়ী নবুয়তের তেইশ বছর সময়ে অল্প অল্প করে অবতীর্ণ হয়। আলেমগণ যদিও এ ব্যাপারে একমত যে,পবিত্র কুরআন রমযান মাসের কদরের রাতে লাওহে মাহফুয থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু অবতীর্ণ হওয়ার ইতিহাস নিয়ে তাঁরা মতবিরোধ করেছেন। আল্লামা সূয়ুতী (র) এ সম্পর্কে তিনটি অভিমত উল্লেখ করেছেন।

১। প্রথম অভিমতঃ  প্রথম অভিমত হল-পবিত্র কুরআন কদরের রাতে লাওহে মাহফুয থেকে দুনিয়ার আসমানে একত্রে অবতীর্ণ হয়। অতঃপর রাসূল (সঃ)-এর নবুয়তের সুদীর্ঘ তেইশ বছর জীবনে প্রয়োজন অনুযায়ী অল্প অল্প করে নাযিল হয়। আর এই মতটিই সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ।

২। দ্বিতীয় অভিমতঃ আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী'র মতে পবিত্র কুরআন লাওহে-মাহফুয থেকে প্রথম আসমানে ক্বদরের রাতে নাযিল হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক বছর ক্বদরের রাতে ততটুকু পরিমাণ কুরআন নাযিল হত যতটুকু ঐ পূর্ণ বছরে প্রয়োজন। অতঃপর সারা বছরে অল্প অল্প করে প্রয়োজনমত প্রথম আসমান থেকে রাসূল (সঃ)-এর নিকট অবতীর্ণ হত।

৩। তৃতীয় অভিমতঃ আল্লামা শাবী (র)-এর অভিমত হল-কুরআন নাযিলের সূচনা হয় লাইলাতুল ক্বদর বা ক্বদরের রাতে। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনের আলোকে সুদীর্ঘ তেইশ বছরে অল্প অল্প করে অবতীর্ণ হয়।

এছাড়া  আল্লামা মাওয়ারিদির অভিমত হল-পবিত্র কুরআন লাওহে মাহফুয থেকে একত্রে নাযিল হয়েছে। আর সংরক্ষক ফেরেশতাগন ক্বদরের রাতে জিবরাইলের নিকট পেশ করেন।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (র) বুখারীর তথা প্রথম মতটিকেই প্রকাশ করেছেন। আর এটা গ্রহনীয় মত।

 

আল-কোরআন  কখন নাযিল হয়ঃ

           আল্লামা যরকানী (র) বলেন কুরআনুল কারীমকে দুইবার নাযিল করা হয়। দুইবার নাযিল করে মূলঃত এই সত্যের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে যে, এই খোদায়ী গ্রন্থ সর্বপ্রকার সংশয়-সন্দেহের ঊর্ধ্বে; রাসুল (স)-এর স্মৃতিপট ছাড়াও তা' আরও দুই জায়গায় লাওহে মাহফুযে ও বাইতুল ইজ্জতে সংরক্ষিত রয়েছে।

কুরআন অবতীর্ণের সময় রাসূল (সঃ)-এর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় এ কথাও প্রকাশ যে, এই অবতীর্ণ আরম্ভ হয় লাইলাতুল ক্বদরে, অর্থাৎ রমজান মাসের সেই তারিখ যে তারিখে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

 কুরআন নাযিলের সূচনা সম্পর্কে স্বয়ং কুরআন থেকেও নিম্নের এই তথ্যাবলী প্রমাণিত হয়ঃ

১। কুরআন নাযিলের সূচনা রমজান মাসে হয়েছে।

২। যে রাত্রিতে কুরআন নাযিল আরম্ভ হয়, তা লাইলাতুল ক্বদর ছিল।

৩। যে তারিখে কুরআন নাযিল আরম্ভ হয়, এগার বছর পর সেই তারিখে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

 

আল-কোরআন নাযিলের পদ্বতি সমুহ কি কিঃ-

      মুফাসসির  এবং আলেমগন রাসূল (সঃ)-এর উপর কুরআন নাযিলের পদ্ধতির কয়েকটি প্রকার বর্ণনা করেছেন। নিম্নে তা আলোচনা করা হল-

১। ঘন্টার আওয়াজের ন্যায়ঃ রাসূল (সঃ)-এর নিকট জিব্রাইল (আঃ) যখন ওহী নিয়ে আসতেন তা শুনে রাসূলের (সঃ) মনে হত ঘন্টার আওয়াজের মত। তা বুখারী ও মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে। আর এ প্রকারটি ছিল ওহী নাযিল হওয়ার কঠিনতম পদ্ধতি। কেননা এতে বোধগম্য হওয়া খুব কঠিন।

২। মানস-পটে ফুঁকে দেওয়াঃ রাসূল (সঃ)-এর অন্তরে কালামকে ঢেলে দেয়া হত বা উদ্রেক করে দেয়া হত।

৩। মানব আকৃতিঃ জিবরাইল (আ) রাসূল (স)-এর নিকট মানুষের রুপ ধারণ করে আগমণ করত এবং সরাসরি কথোপকথন করত। অর্থাৎ সরাসরি মানুষের রুপ ধারণ করে ওহী নিয়ে আসত। আর এটাই ছিল অহীর সহজতর পদ্ধতি।

৪। নিজস্ব আকৃতিঃ কখনও জিবরাইল নিজস্ব আকৃতিতে ওহী নিয়ে আসতেন।

৫। নিদ্রাবস্থায়ঃ রাসূল (সঃ)-এর নিকট নিদ্রাবস্থায় ফেরেস্তা ওহী নিয়ে আগমন করত।

৬। আল্লাহর সাথে সরাসরি বাক্যালাপঃ  রাসুল (সঃ)-এর সাথে আল্লাহর সরাসরি কথোপকথন ও আলাপের মাধ্যমে। এটা আবার দুই প্রকার।

ক) জাগ্রত অবস্থায়ঃ মিরাজের রাতে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত ও কথাবার্তা হয়েছিল, তখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়।

খ) নিদ্রাবস্থায় কথোপকথনঃ নিদ্রাবস্থায় স্বপ্নযোগে আল্লাহর সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে কিছু আয়াত নাযিল হয়। সূরা বাকারার শেষাংশ, এবং দুহার কিছু অংশ, ও আলাম নাশরাকাকে এর অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

ওহী কাশফ ও ইলহামের মধ্যে পার্থক্যঃ

     ওহী একমাত্র আম্বিয়া-কিরামেরই বৈশিষ্ট।যত বড় ওলী আর সাধকই হোক না কেন, আম্বিয়া-কিরাম ছাড়া অন্য কারোর প্রতি ওহী প্রেরণ করা হয় না। অবশ্য কোন কোন সময় আল্লাহ পাক স্বীয় রহমত ও অনুগ্রহে তার খাছ বান্দাদেরকে বিশেষ কোন বিষয় অবগত করিয়ে দেন। এটা ওহী নয় বরং এর নাম 'কাশফ বা ইলহাম'

কাশফ ও ইলহামের পার্থক্য বর্ণনা প্রসংগে মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ) বলেন-

কাশফের সম্পর্ক মূলতঃ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়াদির সাথে। এর  মাধ্যমে কেবল দৃষ্টিশক্তির আয়ত্বাধীন বিষয়বস্তু বা ঘটনা পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে।

পক্ষান্তরে ইলহামের সম্পর্ক উপলব্ধিজনিত বিষয়াধির সাথে। তাই এর মাধ্যমে কোন বস্তু পরদৃষ্ট না হয়ে কোন বিষয় বা কথা মানসপটে উদ্রিক্ত হয়।  এই কারণেই সাধারণতঃ ইলহাম কাশফের তুলনায় বিশ্বাসযোগ্য ও নিশ্চিত হয় বেশী। আল-কুরআন নাযিলের এই পদ্ধতিটা (মানস-পটে ফুঁকে দেওয়াঃ) বাহ্যতঃ অনেকটা ইলহামের নিকটবর্তী। কিন্তু কোন বিষয় অন্তর্লোকে নিক্ষেপ করার বিষয়টি ওহী ও ইলহামের মধ্যে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও প্রকৃতিগত ভাবে এই দুইয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। তা হল-ওহী প্রাপ্তির সাথে সাথে (আম্বিয়া-কিরাম) ওহী নাযিলকারী সত্তা(ফেরেশতা) নিশ্চিতভাবে নির্ণিত হয়।

সুতরাং আম্বিয়া-কিরামের ওহী সম্পুর্ণ সন্দেহমুক্ত,নিশ্চয়তা বিধানকারী ও অকাট্য হয়ে থাকে এবং সেই অনুযায়ী আমল করা ও আনুগত্য স্বীকার করাও সকলের উপর ফরয ও অবশ্য কর্তব্য হিসাবে পরিগণিত হয়।

পক্ষান্তরে আওলিয়া-কিরামের ইলহাম সর্বদিক থেকে সন্দেহমুক্ত ও অকাট্য হয় না। তাই দ্বীন ও শরীয়তের দৃষ্টিতে ইলহাম যেমন প্রামাণ্য পর্যায়ে উপনীত হতে পারেনা, তেমনি এর আনুগত্য স্বীকার করাও জরুরী হিসাবে পরিগণিত হয় না।

মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রঃ) বলেন-'কাশফ ও ইলহাম (সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া) অপরের জন্য দলীল হিসেবে পরিগণিত নয়'। এমনকি কাশফ ও ইলহামের মাধ্যমে প্রাপ্ত কোন বিষয় যদি কুরআন-হাদীসের বিরোধী হয়, তবে সেই অনুযায়ী আমল করাও দুরস্ত হবে না।

আল্লামা হাজার আসকালানী (রঃ) বলেন-'এমনকি  যদি কোন ব্যক্তি কাশফ ও ইলহামের মাধ্যমে কোন বিষয় প্রাপ্ত হয়, তবুও কুরআনের মানদন্ডে তা যাচাই করে নেওয়া তার জন্য জরুরী, নিছক কাশফ বা ইলহামের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দুরস্ত হবে না'।(ফাতহুল বারী)

আল-কোরআন তেলাওয়াত সহজ করার প্রচেষ্টা কে করেনঃ

             হযরত উসমান (রা) কর্তৃক মাসহাফ তৈরীর কাজ চুড়ান্ত হওয়ার পর সমগ্র উম্মত ঐকমত্যে উপনীত হয়েছেন যে, উসমান অনূসৃত লিখন পদ্ধতি ব্যতীত আল-কুরআন অন্য কোন পদ্ধতি অনুসরণে লিপিবদ্ধ করা জায়েয নয়। ফলে পরবর্তীতে সমস্ত মাছহাফ'ই উসমান-এর লিখন পদ্ধতি অনুসরনে লিখিত হয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম ও তাবে'ঈগণ উসমান-এর তৈরী করা মাছহাফ-এর অনুলিপি তৈরী করেই দুনিয়ার সর্বত্র কুরআন ব্যাপকভাবে প্রচার করার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু যেহেতু মূল উসমানী অনূলিপিতে নোকতা ও যের-যবর-পেশ ছিল না সে জন্য অনারবদের পক্ষে এ মাছহাফ-এর তিলাওয়াত অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টকর ছিল। ইসলাম দ্রুত আরবের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে উসমানী অনুলিপিতে নোকতা ওযবর-যের-পেশ সংযোজন করার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হতে শুরু করে। সর্বসাধারনের জন্য তিলাওয়াত সহজতর করার লক্ষে মূল উসমানী মাছহাফ-এর মধ্যে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বিত হয়। সংক্ষেপে প্রক্রিয়াগুলোর বিবরণ নিম্নরুপঃ

নোকতাঃ

       প্রাচীন আরবদের মধ্যে হরফে নোকতা সংযোজন করার রীতি প্রচলিত ছিল না। বরং তারা নোকতাবিহীন অক্ষর লেখায় অভ্যস্ত ছিলেন। তাদের পক্ষে নোকতাবিহীন লিপি পাঠ করার ব্যাপারে কোন অসুবিধাও হতো না। হযরত উসমান মুসলিম জাহানের বিভিন্ন এলাকায় কুরআনের মাছহাফ প্রেরন করার সাথে সাথে বিশিষ্ট তেলাওয়াতকারী হাফেযো প্রেরণ করেছিলেন, যেন লোকজনকে মাছহাফের পাঠোদ্ধারের ব্যাপারে তারা পথ-প্রদর্শন করতে পারেন। বরং সে যুগে অনেক সময় হরফে নোকতা সংযোজন করাকে দোষণীয় কাজ মনে করা হত। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আল্লামা মাদায়েনী এক আরবী সাহিত্যিকের উক্তি বর্ননা করেছেন "লিপির অক্ষরে নুকতা সংযোজন করা বস্তুতঃ প্রাপকের বুদ্ধির স্বল্পতার প্রতি ইংগিত বহন করে"। এ জন্যে উসমানী মাছহাফেও হরফে নোকতা সংযোজিত ছিল না। কিন্তু পরিশেষে অনারব লোকদের এবং অল্প শিক্ষিত ব্যক্তিদের খাতিরে হরফে নোকতা সংযোজিত করা হয়। আল-কুরআনে হরফ সমূহে সর্বপ্রথম নোকতার প্রচলন কে করেছেন এ নিয়ে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তা হল-কারো মতে এ কাজ বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ তাবে'ঈ হযরত আবুল আসাওয়াদ দোয়ালী (র) আনজাম দেন। অনেকের মতে, তিনি এ কাজ হযরত আলী (রা) এর নির্দেশে আনজাম দিয়েছিলেন। কারো মতে কূফার শাসনকর্তা যিয়াদ ইবনে সুফিয়ান আবুল আসওয়াদ (র)-কে দিয়ে এ কাজ করিয়েছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ হযরত হাসান বসরী (র), ইয়াহইয়া ইবন ইয়ামার (র), ও নসর ইবন আসেম লাইসী (র)-এর দ্বারা এ কাজ করিয়েছিলেন।

হরকতঃ

        নোকতার ন্যায় প্রথম অবস্থায় আল-কুরআনে হরকত বা যবর-যের-পেশ ইত্যাদিও ছিল না। সর্বপ্রথম কে হরকত-এর প্রবর্তন করেছেন এ ব্যাপারেও বিরাট মতপার্থক্য রয়েছে। কারো কারো মতে সর্বপ্রথম আবুল আসওয়াদ দোয়ালী (র) হরকত প্রবর্তন করেন। আবার অনেকে মনে করেন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ইয়াহইয়া ইবনে ইয়ামার ও নসর ইবন আসেম লাইসীর দ্বারা এ কাজ করিয়েছিলেন। বিষয়টি পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, কুরআন শরীফের জন্য হরকত সর্বপ্রথম আবুল আসওয়াদ দোয়ালীই আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু তার আবিষ্কৃত হরকতসমূহ আজকাল প্রচলিত হরকতের মত ছিল না। এর কিছুকাল পরে খলিল ইবনে আহমদ (র) হামযা ও তাশদীদের চিহ্ন তৈরী করেন। এরপর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ  উদ্যোগী হয়ে হযরত হাসান বসরী (র), ইয়াহইয়া ইবন ইয়ামার (র), ও নসর ইবন আসেম লাইসী (র) প্রমুখকে আল-কুরআনে নোকতা ও হরকত প্রদানের জন্য নিয়োজিত করেছিলেন। বর্তমানে তাদের আবিষ্কৃত হরকত প্রচলিত আছে।

মানযিলঃ

       আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও মুস্নাদে আহমদের এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে, একদা বনী সাকীফের প্রতিনিধিদল হুজুর (সঃ) এর খেদমতে হাজির হলে রাসুল (সঃ) তাদের নিকট আসতে কিছু বিলম্ব হয়। বিলম্ব হওয়ার কারণ উল্লেখ করে রাসুল (সঃ) বলেন, আমি কুরআন তেলাওয়াতে রত ছিলাম,আজকের দিনের নির্ধারিত অংশ পূরণ করতে কিছু দেরী হয়ে গেছে। আওস সাকাফী এ ব্যাপারে রাসুল (সঃ) এর প্রাত্যহিক তেলাওয়াতের পরিমাণ জিজ্ঞাসা করলে রাসুল (সঃ) নিম্নরুপ উত্তর দিলেনঃ

* প্রথম দিনঃ বাকারা, ফাতেহা, আল ইমরান, নিসা।(৪)

* দ্বিতীয়  দিনঃ মায়িদাহ, আনআম, আ'রাফ, আনফাল,বারায়াত। (৫)

* তৃতীয় দিনঃ ইউনুস, হুদ, ইউসুফ, রা'দ, ইব্রাহীম, হিজর, নাহল।(৭)

* চতুর্থ দিনঃ বনী ইসরাঈল, কাহাফ, মারইয়াম, তোয়াহা, আম্বিয়া, হজ্জ, মু'মিনুন, নূর, ফোরক্বান,(৯)

* পঞ্চম দিনঃ শুয়ারা, নামল, ক্বেছাছ, আনকাবুত, রুম, লোকমান, সেজদা, আহযাব, সাবা, ফাতির, ইয়াসীন।(১১)

* ষষ্ঠ দিনঃ ছাফফাত, ছোয়াদ, যুমার, মুমিন, হামীম সেজদাহ, শূরা, যুখরুফ, দুখান, জাছিয়া, আহক্বাফ, মুহাম্মদ, ফাতহ,হুজরাত।(১৩)

* সপ্তম দিনঃ ক্বাফ থেকে নাস পর্যন্ত।(৬৫)

সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীগণের অনেকেই সপ্তাহে অন্ততঃ এক খতম কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। এই জন্য তারা  দৈনিক তেলাওয়াতের উক্ত পরিমান নির্ধারন করে নিয়েছিলেন। সেই পরিমানটুকুর নামই হল মনযিল। এই কারণে কুরআন শরীফ সাত মনযিলে বিভক্ত হয়েছে। একে  আবার হেযব ও বলা হয়।

পারাঃ

      কুরআন শরীফ সমান ত্রিশটি খন্ডে বিভিক্ত, এ খন্ডগুলোকে পারা বলে অভিহিত করা হয়। পারার এ বিভক্তি অর্থ বা বিষয়বস্তু ভিত্তিক নয়; বরং পাঠের সুবিধার্থে সমান ত্রিশটি খন্ড করে দেওয়া হয়েছে। কেননা, অনেক সময় দেখা যায় কোন একটা প্রসংগের মাঝখানেই একটা পারা শেষ হয়ে নতুন পারা আরম্ভ হয়ে গেছে। ত্রিশ পারায় বিভক্তি কার দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে সে তথ্য উদ্ধার করা কঠিন। অনেকের ধারনা উসমান (রা) যখন কুরআন শরীফের অনুলিপি তৈরী করেন, তখন এ ধরণের ত্রিশটি খন্ডে তা লিখিত হয়েছিল। এবং তা থেকেই ত্রিশ পারার প্রচলন হয়েছে। কিন্তু পুর্ববর্তী যুগের নির্ভরযোগ্য কোন আলেমের কিতাবেই এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায়নি। আল্লামা বদরুদ্দীন যরকাশী লিখেন, কুরআনের ত্রিশ পারা বহু আগে থেকেই চলে আসছে। বিশষতঃ মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেই এ ত্রিশ পারার রেওয়াজ বেশী চলে আসছে। অনেকে মনে করেন, ত্রিশ পারার এ বিভিক্তি সাহাবায়ে কিরামের যুগের পর শিক্ষাদান কার্যে সুবিধার জন্য করা হয়েছে।

আখমাস ও আশারঃ

         প্রাথমিক যুগের লিখিত কুরআনে নুসখার আগে দু'টি আলামত দেখা যেত,প্রতিটি পাঁচ আয়াতের পর পাতার পাশে  আরবীতে "খা" হরফটি লিখা থাকত। দশ আয়াতের পরে আরবীতে "আ'ইন" হরফটি লিখা থাকত। প্রথম চিহ্নটিকে আখমাস এবং পরবর্তী চিহ্নটিকে আশার বলা হত। কেউ এই চিহ্নটিকে ব্যবহার করা জায়েয আবার অনেকে একে মাকরুহ বলেছেন। অনেকের মতে এ চিহ্ন সর্বপ্রথম ব্যবহারের প্রবর্তন করেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। আবার অনেকের মতে আব্বাসী বংশের খলীফা মামুন এ চিহ্নের প্রবর্তন করেছিলেন। তবে এর কিছু প্রচলন সাহাবায়ে কিরামের যুগেও প্রচলন ছিল।

রুকুঃ

      আখমাস এবং আশারের আলামত পরবর্তী যুগে পরিত্যক্ত হয়ে অন্য একটা আলামতের ব্যবহার প্রচলিত হয়। বর্তমানকাল পর্যন্ত প্রচলিত এ চিহ্নটিকে রুকু বলা হয়। এ চিহ্নটি আয়াতে আলোচিত বিষয়বস্তুর প্রতি লক্ষ্য রেখে নির্ধারন করা হয়েছে। একটা প্রসংগ যেখানে এসে শেষ হয়েছে, সেখানে পৃষ্ঠার পাশে রুকুর চিহ্নস্বরুপ অক্ষর অঙ্কিত করা হয়। এ চিহ্ন কখন কার দ্বারা প্রচলিত হয়েছে তার নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে আছে, সমগ্র কুরআনে পাঁচশত চল্লিশটি রুকু রয়েছে। তারাবীহ নামাযের প্রতি রাকাতে যদি এক রুকু করে তেলাওয়াত করা হয়, তবে সাতাশে রমজান কুরআন খতম হয়ে যাবে।

যতিচিহ্নঃ

      শুদ্ধ তেলাওয়াতের সুবিধার্থে আয়াতের মধ্যে কয়েক প্রকারের যতিচিহ্নের প্রচলণ করা হয়েছে। এ চিহ্নগুলোর দ্বারা কোথায় থামতে হবে,কোন জায়গায় কিছুটা শ্বাস নেয়া যাবে, এ সম্পর্কিত নির্দেশাবলী জানা যায়। এ চিহ্নগুলোকে পরিভাষায় 'রুমূযে-আওক্বাফ' বলা হয়। এ গুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, একজন আরবী নাজানা লোকও যেন সহজে বুঝতে পারেন,কোথায় কতটুকু থামতে হবে, কোথায় থামলে পর অর্থের বিকৃতি ঘটতে পারে।এ চিহ্নগুলোর অধিকাংশ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে তাইফুর সাজাওয়ান্দী কর্তৃক প্রবর্তিত হয়েছিল।

সূরাঃ

    কিছু মুফাসসির-এর মতে, সূরা শব্দের অর্থ হল অতিরিক্ত পানীয়, কুরআনের অংশ, শহর বেষ্টনী, চিহ্ন, নিদর্শন, উচ্ছস্থান, মর্যাদা, দীর্ঘ ও সুরম্য প্রাসাদ।

ইমাম জা'বরী (র)-এর মতে- সূরা হল যা কুরআনের কতগুলো আয়াতকে শামিল করে যার শুরু এবং শেষ রয়েছে এবং তার নিম্নসংখ্যা হল তিন আয়াত।

আল্লামা সাইয়্যেদ আমীমুল ইহসান (র)-এর মতে-সূরা হল কুরআনের কিছু অংশের নাম যা রাসুল (সঃ)-এর পক্ষ থেকে নির্দিষ্টভাবে নামকরন করা হয়েছে। যার নিম্নসংখ্যা হল তিন আয়াত।

আয়াতঃ

      এর অর্থ চিহ্ন, নিদর্শন, উপদেশ, বিস্ময়কর, কতকগুলো বর্ণের সমষ্টি।

ইমাম জাবরী (র)-এর মতে-আয়াত হল কুরআনের কতকগুলো বাক্যের সমাবেশ যদিও উহ্যভাবে হোক যার শুরু এবং শেষ আছে এবং সূরার অংশ হিসেবে সন্নিবেশিত।

আল বুরহান গ্রন্থ প্রণেতা বলেন-আয়াত হল কুরআনের একটি অংশ যা তার পূর্বের অংশ ও পরের অংশ থেকে পৃথক এবং এর এক অংশের সাথে অন্য অংশের সাদৃশ্য নেই।

কেউ কেউ বলেন-আয়াত হল কুরআনুল কারীমের কতকগুলো শব্দ সমষ্টির নাম যা নির্ধারিত পৃথককারী চিহ্ন দ্বারা পৃথক করা হয়েছে।

কোরআনের সর্বপ্রথম আয়াত কোনটিঃ

               কুরআনের সর্বপ্রথম আয়াত সম্পর্কে ইমামদের মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়। তা বিস্তারিত বর্ননা করা হল-

প্রথম ও প্রাধান অভিমতঃ কুরআনুল কারীমের সর্বপ্রথম যা অবতীর্ণ হয় তা হল সূরা আলাক্বের প্রথম পাঁচ আয়াত।

এই মতের পক্ষে যারা অভিমত পেশ করেছেন তাদের দলীল হল-ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন রাসুল (স)-এর প্রতি প্রথম যে অহী শুরু হয়, তা ছিল সত্য স্বপ্ন। তিনি স্বপ্নে যা কিছু দেখতেন, তাই বাস্তবে প্রতিফলিত হত। অতঃপর তাঁর কাছে নির্জনবাস ও ধ্যানমগ্ন থাকা পছন্দনীয় হতে লাগল। তখন তিনি হেরা পর্বতের গুহায় গিয়ে নির্জনে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। সেখানে তিনি একাধারে কয়েক রজনী বা দিবস কাটাতেন। অতঃপর খাদীজার গৃহে ফিরে আসতেন এবং পুনরায় খাদ্য সামগ্রী নিয়ে হেরা গুহায় চলে যেতেন এবং ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এভাবে কিছুকাল অতিবাহিত হলে একদা সত্য তাঁর নিকট আগমন করল। হযরত জিবরাইল তাঁর নিকট আসলেন এবং তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, "ইক্বরা" আপনি পড়ুন।রাসূল (স) বললেন আমি পড়তে জানিনা। তখন জিবরাইল রাসূল (স)-কে জড়িয়ে ধরলেন ও আলিঙ্গন করলেন। অতঃপর বললেন,"ইক্বরা"আপনি পড়ুন। রাসুল (স) উত্তরে বললেন আমি পড়তে জানিনা। জিবরাইল পুনরায় রাসুল(স)-কে আলিঙ্গন করলেন। এরুপে তিনবার আলিঙ্গন করার পর বললেন-সুরা আলাক্বের প্রথম পাঁচ আয়াত। রাসুল (স) উক্ত আয়াত মুখস্থ করে খাদীজার ঘরে ফিরে আসলেন।

ইমাম হাকেম (র) এবং ইমাম বায়হাকী (র) তাদের গ্রন্থে উক্ত মতের পক্ষেই দলীল পেশ করেন।

আল্লামা তিবরানী (র) কাবীর নামক গ্রন্থে আবু রাজা আতারাদী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, যখন আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) আমাদেরকে পড়াতেন তখন আমাদেরকে বৃত্তাকারে বসাতেন, আর তার পরনে থাকত সাদা দুটি জামা। অতঃপর যখন সুরা আলাক্বের প্রথম আয়াতগুলো পড়াতেন তখন বলতেন এটা হল প্রথম সুরা যা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উপর নাযিল হয়েছিল।

হযরত মুজাহিদ, ইবনে শিহাব যুহরী, ওবায়েদ ইবনে ওমায়ের (রা) প্রমুখ উক্ত মতের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

দ্বিতীয় মতঃ কারো মতে কুরআনের সর্বপ্রথম সূরা ফাতিহা নাযিল হয়। ইমাম বায়হাকী তার দালায়েল গ্রন্থে এর পক্ষে একটা দলীল পেশ করেন। অনেকে একে এব্যাপারে দুর্বল মনে করেছেন।

তৃতীয় মতঃ একদল আলেমের মতে, সর্বপ্রথম কুরআনের অবতীর্ণায়াত হল সূরা মুদ্দাচ্ছির।

চতুর্থ মতঃ হযরত ইকরামা ও হাসান বসরী (র) বলেন-সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াত হল- বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।

 

শানে নযুল কি,শানে নযুল জানার গুরুত্ব বা উপকারিতা কিঃ

         কুরআনুল কারীমের আয়াতসমুহ দুই প্রকারেরঃ প্রথমতঃ ঐ সমস্ত আয়াত যেগুলি কোন উপলক্ষ ছাড়া আল্লাহ তাআলা বর্ননামুলকভাবে নাযিল করেছেন। অর্থাৎ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে বা কারো প্রশ্নের জবাব দানের উদ্দেশ্যে নাযিল করেননি। দ্বিতীয়তঃ ঐ সমস্ত আয়াত যেগুলি সংঘটিত কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অথবা উত্থাপিত কোন প্রশ্নের জবাবে নাযিল করা হয়েছে। মূলতঃ আয়াত নাযিল হওয়ার পটভূমিতে বিদ্যমান এইরুপ প্রশ্ন বা ঘটনাকে সেই আয়াতের 'শানে যুল' বা 'সববে নুযূল' বলা হয়।

দৃষ্টান্ত স্বরুপ সূরা বাকারার এই আয়াতটি উল্লেখ করা যেতে পারে

"আর তোমরা মুশরেক নারীদেরকে বিয়ে করোনা, যতক্ষণ না তারা ঈমান গ্রহণ করে। অবশ্য মুসলমান ক্রীতদাসী মুশরেক নারী অপেক্ষা উত্তম, যদিও তাদেরকে তোমাদের কাছে ভালো লাগে"। (বাক্বারা ২২১)

উক্ত আয়াতটি একটি বিশষ ঘটনার পটভূমিতে নাযিল হয়েছে।

শানে নুযুল জানার মাঝে অনেক উপকারীতা রয়েছে। আল্লামা সুয়ূতী (র) ইতকান গ্রন্থে শানে নুযুল জানার কয়েকটি বিশেষ উপকারীতা বর্ণনা করেছেন।

১। শানে নুযুল জানার মাধ্যমে আয়াতের মর্মার্থ খুব সহজে জানা যায় এবং বাক্যের অর্থ বুঝার ব্যাপারে সব সমস্যা দূরীভূত হয়।

২। শরীয়তের বিধানাবলীকে বিধান হিসেবে প্রয়োগ করার মূল রহস্য অবগত হওয়া। শানে নুযুল জানার মাধ্যমে শরীয়তের বিধি-বিধানসমুহের কারণ ও রহস্য জানা যায়।

৩। যে সব মুফাসসির মনে করেন যে, অবতারিত আয়াতের হুকুম বা বিধান শানে নুযুলের সাথে নির্দিষ্ট, তাদের মতানুযায়ী সে বিধানকে নির্দিষ্ট করতে হলে ঐ আয়াতের শানে নুযুল জানা অত্যাবশ্যক। নতুবা সে হুকুমকে খাস করা সম্ভব হবে না।

৪। কোন কোন সময় কুরআনের শব্দ ব্যাপক অর্থবোধক হয়,কিন্তু ঐ শব্দকে নির্দিষ্ট করার দলীলও বিদ্যমান থাকে। এমতাবস্থায় আয়াত নাযিলের কারন জানা থাকলে অন্যান্য বাহ্যিক অর্থ থেকে দলীলের মাধ্যমে হুকুমকে নির্দিষ্ট করা যায়।

৫। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (র) বলেন-শানে নুযুল জানা কুরআনে কারীমের আয়াতের অর্থ বুঝার জন্য সহায়ক। শানে নুযুল হল আয়াতের নাযিলের কারন। সুতরাং শানে নুযুল জানা থাকলে আয়াতের অর্থ অনায়াসেই বুঝা যাবে।

৬। আল্লামা ওয়াহেদী (র) বলেন- কুরআনের আয়াতের শানে নুযুল এবং ঘটনা জানা ছাড়া কোন আয়াতের তাফসীর জানা সম্ভব নয়।

৭। কেউ কেউ বলেন- কুরআনুল কারীমের মর্মার্থ বুঝার জন্য শানে নুযুল জানা একটি শক্তিশালী পন্থা।

কোন কোন মুফাসসির মনে করেন, পবিত্র কুরআন হল সর্বকালের সর্বযুগের মানুষের সার্বিক সমস্যার একমাত্র সমাধান গ্রন্থ। সুতরাং এর অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক ও সর্বজনীন। এর অর্থকে শানে নুযুল এর মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট অর্থে খাস করা ঠিক নয়। সুতরাং শানে নুযুল জানার প্রয়োজনীয়তা নেই।

আল্লামা সুয়ূতী (র) তাদের মতামতকে প্রত্যাখান করে বলেন-যারা মনে করেন কুরআনের শানে নুযূল জানার মধ্যে তেমন কোন উপকারিতা নেই তারা এ ব্যাপারে ভুল করেছেন। বরং এটা জানার মাঝে অনেক উপকারীতা রয়েছে।

কেননা পবিত্র কুরআন যদিও সর্বজনীন ও ব্যাপক বটে তবুও এর অধিকাংশ আয়াত ও সূরা তৎকালীন মানব সমাজ ও ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়। তা না হলে বিনা কারণে ও বিনা প্রেক্ষাপটে কুরআন নাযিল হলে এর গুরুত্ব তেমন অনুধাবন হত না। বরং তখন কুরআনের প্রতি অপবাদ দেয়া হত যে,এটা ঐতিহাসিক কোন প্রেক্ষাপট ছাড়াই বিনা কারণে নাযিল হয়েছে। অতএব কুরআনের শানে নুযুল জানার মাঝ অনেক উপকারিতা রয়েছে  এতে কোন সন্দেহ নেই।

নসখ, মানসুখ, ও নাসেখঃ-

    আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মানুষের কল্যাণ সম্পর্কে ভাল জানেন। তাই তিনি কখনো একটি বিধান প্রবর্তন করেন, আবার মানুষের মঙ্গলের দিক চিন্তা করে তিনিই আবার সেই বিধানটি পরিবর্তন করে দেন। উসূলে তাফসীরের পরিভাষায় এটাকে 'নসখ' বলে। এই ভাবে পরবর্তী যে নির্দেশটিকে রহিত করা হয়, সেটাকে বলা হয় 'মানসুখ' এবং এর পরবর্তীতে যে নতুন নির্দেশ আসে সেটাকে 'নাসেখ' বলা হয়। নিন্মে আরো বিস্তারীত আলোচনা করা হল।

  নসখ শব্দের অর্থ হল বিদূরীত করা, পরিবর্তন করা, রূপান্তর করা, স্তানান্তর করা, বাতিল করা ইত্যাদি।

১। ড. মুহাম্মদ ইযায (র) বলেন- উসুলবিদদের নিকট শরীয়ত প্রণেতা কর্তৃক প্রবর্তিত কোন শরয়ী হুকুমকে পরে প্রবর্তিত অন্য হুকুম দ্বারা রহিত করাকে নসখ বলে।

২। আল্লামা সাঈদ আহমদ বলেন- নসখ হল কোন শরয়ী হুকুমকে অন্য শরয়ী হুকুম দ্বারা বিলুপ্ত করা।

৩। মুতাকাদ্দিমীন তথা সাহাবী ও তাবেয়ীনদের মতে, নসখের আভিধানিক অর্থ হল একটি বস্তু দ্বারা অন্য একটি বস্তুকে অপসারন করা। এ হিসেবে নসখ হল পরে নাযিলকৃত কোন আয়াত দ্বারা পুর্বে নাযিলকৃত আয়াতের কোন গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে অপসারণ করা। আর তা আমলের সময়সীমা শেষ হওয়ার কারণে বা অর্থের দিকে আয়াতকে পরিবর্তন করার কারণে অথবা "আ'ম"-কে 'খাস' করার কারণে হবে।

৪। মুতায়াখখিরীনের মতে- নসখ হল কোন আয়াত দ্বারা পুর্ববর্তী কোন আয়াতের হুকুমকে রহিত করা।

মানসুখ আয়াতের সংখ্যাঃ-

    মুতাকাদ্দিমীন তথা সাহাবী ও তাবেয়ীদের মতে রহিত আয়াতের সংখ্যা পাঁচশতের অধিক। কারন তারা 'নসখ'-কে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করে থাকেন।

কিন্তু ওলামায়ে মুতায়াখখিরীনের মতে, রহিত আয়াতের সংখ্যা ২০-এর কাছাকাছি বা এর চেয়েও একটু বেশি। যেমন-

   সুরা বাকারাতে ৬ টি।   সুরা নূরে ২টি।  সুরা আলে ইমরানে ১টি।   সুরা আহযাবে ১টি।

   সুরা নিসাতে ৩টি।   সুরা মুজদালাতে ১টি।   সুরা মায়েদাতে ৩টি।   সুরা মুমাতাহিনাতে ১টি।

   সুরা আনফালে ১টি।   সুরা মুযযাম্মিলে ১টি।  সুরা তাওবাতে ১টি। মোট ২১টি।

আল-কোরআন সংরক্ষন সাহাবীদের নামঃ-

      প্রাথমিক যুগে আল-কুরআন সংরক্ষনের ক্ষেত্রে হিফয-এর প্রতিই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত।। আরবদের স্মরণ শক্তি ছিল অতি তীক্ষ। কুরআনের যে অংশ যখন নাযিল হত, নবী করীম (স) সাথে সাথে তা মুখস্থ করতেন। এবং সাহাবায়ে কিরামকে প্রথমে আল-কোরআন মুখস্থ করাতেন, তার পর আয়াতের মর্মার্থ শিক্ষা দিতেন। তাদের এমন প্রবল আগ্রহ ছিল যে, প্রত্যেকেই এ ব্যাপারে অন্যদের ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতেন। সীমাহীন আগ্রহ ও অসাধারণ অধ্যবসায়ের ফলে খুব অল্প দিনেই সাহাবীদের মধ্যে একদল হাফিযে কুরআন তৈরী হয়ে গেলেন। এ হাফিযদের মধ্যে ছিলেন প্রথম চার খলিফা, হযরত তালহা, সালেম, ইবন মাসউদ, হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আমর ইবনুল আস, আবদুল্লাহ ইবনে আমর, মুয়াবিয়া,আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর, আবদুল্লাহ ইবন সায়েব, হযরত আয়েশা, হযরত হাফসা, ও হযরত উম্মু সালামা (রা)। এদের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যায়।

আল-কোরআন কি ভাবে সংরক্ষন করা হয়ঃ-

   বিশ্বমানবতার প্রতি মহান আল্লাহর অফুরন্ত দান হচ্ছে আল-কুরআন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং এ কিতাবের সংরক্ষণকারী বলে ঘোষণা করেছেন।আল্লাহ বলেন- "নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী।"

      আরবদের স্মরণ শক্তি ছিল অতি তীক্ষ। কুরআনের যে অংশ যখন নাযিল হত, নবী করীম (স) সাথে সাথে তা মুখস্থ করতেন। নবী (স) বলেন- কখনও কখনও জিব্রাইল আমার কাছে মানুষের আকৃতিতে আগমন করে আমার সাথে কথা বলতেন। অতঃপর তিনি যা বলতেন তা আমি মুখস্থ করতাম। (বুখারী)

       এমনকি  ওহী নাযিল হওয়ার সময় নবী (স) তাঁর দুই ঠোঁট নেড়ে মুখস্থ করার চেষ্টা করলে আল্লাহ তাঁ তা থেকে বিরত থাকার জন্য আদেশ করে বলেন-"কুরআনকে দ্রুত আয়ত্ত করার জন্য আপনার জিহ্বাকে সঞ্চালন করবেননা।  নিশ্চয় কুরআন একত্রিত করা ও পাঠ করার দায়িত্ব আমারই। সুতরাং আমি যখন তা পাঠ করি তখন আপনি সে পাঠের অনুসরন করুন।"(কিয়ামাহঃ১৬-১৮)

       অনেক সাহাবী কুরআনের হাফেজ ছিলেন। হাফিযে কুরআন সাহাবীদের কন্ঠে কুরআনের বাণীর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হতে থাকত। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে হাজার হাজার কুরআনে হাফিয বিদ্যমান আছেন।

      কুরআনে মাজিদকে মুখস্থ করা ছাড়াও রাসুলুল্লাহ (স)-এর যুগেই তা সুষ্ঠভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। তখনকার যুগে  লেখার উপকরন ছিল দুর্লভ। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কৃত না হওয়ায় সাহাবীগণ কুরআনের আয়াত খেজুরের ডাল, প্রস্তর খন্ড, চামড়া-উটের চামড়া, হাড়, কাপড়ের টুকরা, গাছের পাতা, প্রভৃতি বস্তুর উপর লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষন করেন।

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহাবী যায়িদ বিন সাবিত (রাঃ) বর্ণনা করেন-"আমরা রাসুলের (স) নিকটে চামড়া অথবা গাছের পাতায় কুরআন লিপিবদ্ধ করতাম।"(ইতকান,১ম খন্ড)

      তা ছাড়া কুরআন নাযিলের সময় কুরআনের আয়াতসমুহ হাদীসের সাথে সংমিশ্রণের ভয়ে রাসুল (স) সাহাবীদের শুধু কুরআন লিপিবদ্ধ করার আদেশ দিতেন। এ প্রসঙ্গে আবু সাঈদ (রাঃ) বলেনঃ "রাসুল (স) এরশাদ করেন,আমার পক্ষ হতে কুরআন ছাড়া অন্য কিছু লিখো না।" (মুসলিম)

     সারা বছর অবতীর্ণ কুরআন জিব্রাইল (আ) রমযান মাসে এসে মহানবী (স)-কে শুনাতেন। মহানবী (স) ও জিব্রাইলকে পাঠ করে শুনাতেন। তখন কোন আয়াত আগে, কোন আয়াত পরে তা নির্ধারিত হত। এ পারস্পরিক পাঠের মাধ্যমে পূর্ববর্তী নাযিলকৃত কুরআন বা এর অংশ যথাযথভাবে সংরক্ষিত হত।

আল-কুরআন সংকলনের ইতিহাসঃ-

      মহাগ্রন্থ আল-কোরআন গ্রন্থাকারে একেবারে নাযিল হয়নি বরং প্রয়োজনানুপাতে ধীরে ধীরে দীর্ঘ ২৩ বৎসর যাবৎ নাযিল হয়েছে। যার সূচনা হয়েছিল মক্কার আদুরে হেরা পর্বতের গুহায় সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াতের মাধ্যমে। পরবর্তীতে আল্লাহ তালার অনুমতিক্রমে জিব্রাইলের নির্দেশনা অনুযায়ী একে সংকলন করআ হয়। জানা প্রয়োজন যে, কুরআন সংকলনের ইতিহাস কয়েকটি যুগে বিভক্ত।

মহানবী (স) এর যুগঃ-

      মহানবী (স)-এর জীবদ্দশায় তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রথম পূর্ণ কুরআন লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু এগুলো এক জায়গায় একত্রিত করে গ্রন্থাকারে সাজানো হয়নি। তবে কোন সুরার অবস্থান কোথায়, কোন আয়াত আগে, কোন আয়াত পরে হবে তা নির্ধারিতকরা হয়।

হযরত আবু বকর (রা)-এর যুগঃ-

      আবু বকর (রা)-এর আমলে ভন্ডনবী মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের বিরুদ্ধে ইয়ামামার যুদ্ধে হাফিযগনের একটি বড় অংশ সাহাদাত বরন করেন। এতে হযরত উমর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আবু বকর (রা) উমরের পরামর্শক্রমে রাসুল (স)-এর যুগের ওহী লিখক যায়েদ ইবনে সাবিত (রা)-কে এ গুরূদ্বায়িত্ব প্রধান করেন।

      যায়িদ ইবনে সাবিত (রা) নিজেই কুরআনে হাফিজ ছিলেন। তিনি কুরআন সংকলন এর ব্যাপারে দু'টি পদ্ধতি অবলম্বন করেন। একটি হল-কুরআনের আয়াত সংশ্লিষ্ট সাহাবী বলবেন, আর অপরটি হল তিনি মহানবী (স)-এর যুগে লিখিত ঐ আয়াতটি প্রদর্শন করবেন। তিনি লিখিত ছাড়া কুরআনের আয়াত সত্যায়নের জন্য শুধু হিফয যথেষ্ট মনে করেননি। তিনি বহু যাচাই বাছাই করতঃ সাহাবায়ে কিরামের নিকট রক্ষিত রাসুল (স)-এর জীবদ্দশায় লিখিত বিভিন্ন পান্ডুলিপি থেকে সে সময়ের আবিষ্কৃত বিশেষ কাগজে গ্রন্থাকারে কুরআন লিপিবদ্ধ করেন।

    লিপিবদ্ধ কুরআনখানা আবু বকর (রা)-এর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। তার ওফাতের পর এটি হযরত উমর (রা)-এর হিফাযতে থাকে। তার শাদাতের পর তারই ওয়াসিয়ত অনুসারে কুরআনের এই কপিটি নবী (স)-এর স্ত্রী বিবি হাফসা (রা)-এর নিকট গচ্ছিত থাকে।

হযরত উসমান (রা)-এর যুগঃ-

       হযরত উসমান (আ)-এর যুগে ইসলাম বিজয়ী বেশে দুরদুরান্তে ছড়িয়ে যায়। হযরত হুযাইফা (রা) ইয়ামান, আরমিনিয়া,আজারবাইজান সীমান্তে জিহাদে মশগুল থাকা অবস্থায় দেখলেন সেখানে মানুষের মাঝে কুরআনের পঠন রীতি নিয়ে মতবিরোধ চলছে। এমনকি একদল আরেক দলকে কাফের পর্যন্ত বলছে।তিনি জিহাদ থেকে ফিরে উসমানকে এক রীতিতে কুরআন পড়ার রেওয়াজ জারী করার কথা বলেন। উসমান অবিলম্বে এ নিয়ে নেতৃস্থানীয় সাহাবীগনের সাথে পরামর্শ করে চার জন বিশিষ্ট সাহাবী সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করেন। এ চার জন সাহাবী হলেন-যায়িদ ইবনে সাবেত, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, সাঈদ ইবনুল আ'স এবং আবদুর রহমান ইবনে হারিস (রা)।

     হযরত উসমান (রা)-এর উদ্দোগে হিজরী ২৪ সালে শেষবারের মত কুরআন সংকলনের মত এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ বোর্ড হযরত হাফসা (রা)-এর নিকট সংরক্ষিত মূল কপিটি সংগ্রহ করেন। উক্ত বোর্ড পূর্বলিখিত কপিটি অনুসরন করে পাঠ ও উচ্ছারণের বিভিন্নতা দূর করার জন্য শুধু কুরাইশী উচ্ছারণ ও ভাষায় তার আরো সাতটি কপি প্রস্তুত করেন।

     বর্ণিত আছে যে, সাতটি কপি তৈরী করে মক্কা, শাম, ইয়ামান, বাহরাইন, বসরা, কূফা প্রদেশে একটি করে প্রেরণ করা হয়। আর রাজধানী মদীনাতে একটি কপি খলিফার নিকট সংরক্ষিত রাখা হয়।

    এরপর বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য বিক্ষিপ্তভাবে সংরক্ষিত কপিগুলো সকলের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বিনষ্ট করে দেয়া হয়। এভাবে উসমান (রা)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পবিত্র কুরআন সংকলিত ও বিভিন্ন প্রদেশে প্রেরিত হয় বিধায় তাকে "জামেউ'ল কুরআন" বা কুরআন সংগ্রহকারী বলা হয়। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মাছহাফে উসমানীর অনুকরণে সুন্দর হস্তলিপি দ্বারা কোরান লিখা হত। ১১৩ হিজরী প্রথম জার্মানের হামবুর্গে কুরআন মুদ্রন হয় যার এক কপি এখনো মিশরে আছে। এতে হরকত ও নোকতা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের আদেশে আবুল আসওয়াদ দোয়াইলী (রহ) লাগিয়েছিলেন।

     কুরআনের এ সংগ্রহে আল্লাহর হুকুম অনুসারে মহানবী (স) কর্তৃক সাজানো আয়াত ও সুরা সমুহের কোন স্থান পরিবর্তন করা হয়নি। কেননা, আয়াতের ক্রমধারা রক্ষা করা ওয়াজিব। সুরা সমুহের ক্রমধারাও আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে। বর্তমানে কুরআন মাজিদের সুরা গুলো ঠিক সেভাবেই সজ্জিত রয়েছে যেভাবে লাওহে মাহফুযে কুরআন সংরক্ষিত আছে।

ওহীর পরিচয়ঃ-

     জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম তিনটি। যথা-পঞ্চ ইন্দ্রিয়, আকল, ওহী। প্রথম দুটি দ্বারা কেবল বাহ্যিক ও চাক্ষুষ বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করা যায়। কিন্তু ইন্দ্রিয় ও আকল যেখানে আকর্যকর সে জ্ঞান একমাত্র ওহীর দ্বারাই লাভ করা সম্ভব। যেমন আখেরাত, জান্নাত, জাহান্নাম, ইত্যাদির জ্ঞান। তদ্রুপ মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য শুধু বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয় যথেষ্ট নয় বরং ওহীর জ্ঞান প্রয়োজন। এমনিভাবে দ্বীনের আকীদা সম্পর্কীয় জ্ঞান লাভ করা ও ওহীর কাজ বুদ্ধির কাজ নয়। তাইতো আল্লাহ পাক যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন ওহীর জ্ঞান দিয়ে। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ মহানবী (স)-কে  সর্বশেষ ওহী তথা আল-কোরআন দিয়ে প্রেরণ করেছেন।

    ওহী আরবী শব্দ এর অর্থ গোপনে জানিয়ে দেওয়া, এলহাম, চিঠি ,অন্তঃকরণে ভাব সৃষ্টি করা ইত্যাদি।

   আল্লামা আহমদ আলী সাহারানপুরী (র) বলেন-নবীদের উপর আল্লাহ তায়ালার অবতারীত বানীকে ওহী বলে।

   রাসুল (স)-এর উপর যে ওহী অবতীর্ণ হয়েছে তা দুই প্রকার-

   ১। ওহী মাতলু বা নিত্য পঠিত ওহী, যা হযরত জিবরাইল (আ) রাসুল (স)-কে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। যেমন  পুরো আল-কুরআন।

   ২। ওহী গাইরে মাতলু বা  নিত্য অপঠিত ওহী, যা পাঠ করে শুনানো হয়নি, বরং ইলহামের মাধ্যমে জানানো হয়েছে। যেমন আল-হাদীছ।

ওহী কিসের মধ্যে লিখা হতঃ-

        যখন আল-কুরআন নাযিল হয় তখনকার যুগে লেখার উপকরন ছিল খুবই দুর্লভ। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কৃত না হওয়ায় সাহাবীগণ নাযিলকৃত কুরআনের আয়াত খেজুরের ডাল, প্রস্তর খন্ড, চামড়া-উটের চামড়া, হাড়, কাপড়ের টুকরা, গাছের পাতা, বাকল, বাঁশের টুকরা, পশুর হাড়,পাথর-শিলা প্রভৃতি বস্তুর উপর লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষন করেন। তাদেরকে কাতীবে ওহী বলা হত। নবী (স)-এর দরবারে মোট ৪২ জন কাতীবে অহী ছিলেন।

ওহী লেখক কারা ছিলেনঃ-

    রাসুল (স)-এর নিকট যখন কোন ওহী আসত তখন একদল সাহাবী ওহীগুলো বিভিন্ন জিনিসের উপর লিখে রাখতেন, এদেরকে কাতীবে ওহী বলা হত।  প্রায় ৪২ জন সাহাবী ওহী লিখেছেন। রাসুল (স)-এর নিকট হযরত জিব্রাইল (আ) কুরআনের যে অংশ যখন নিয়ে আসতেন, তা কোন সুরার কোন স্থানে সংযোগ করতে হবে তা তিনি  বলে দিতেন। আর রাসুল (স) তখন ওহী লিখক সাহাবীদের ডেকে অবতীর্ণ অংশকে সংশ্লিষ্ট সূরার নির্ধারিত স্থানে সংযোগ করার নির্দেশ দিতেন। কাতীবে  ওহীদের অন্যতম হলেন হযরত যায়িদ ইবনে সাবিত (রা)। হযরত আবু বকর, উমর, উসমান, আলী (রা), উবাই ইবন কা'ব, আয যুবাইর ইবনুল আওয়াম, হযরত মু'আবিয়া, আব্বাস ইবনুল সা'ঈদ, আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা, ইবন মাসউদ, খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ, মুগীরা ইবন শু'বা ও হানযালা (রা)[এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

মাক্কী ও মাদানী সূরা বা আয়াতের মধ্যে পার্থক্যঃ-

   মাক্কী ও মাদানী সূরার ব্যাপারে রাসুল (স) সুস্পষ্ট কোন পরিচয় বর্ণনা করেননি। সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পবিত্র কুরআনের সূরা সমুহকে মাক্কী ও মাদানী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে মাক্কী সূরা যা হিজরতের পূর্বে নাযিল হয়েছে। আর মাদানী হচ্ছে যা হিজরতের পরে নাযিল হয়েছে। চাই তা মক্কায় নাযিল হোক বা মদীনায় নাযিল হোক। মক্কা বিজয়ের বছর নাযিল হোক বা বিদায় হজ্জের বছর নাযিল হোক।

মাক্কী আয়াতের পরিচয়ঃ

     মাক্কী আয়াত চেনার ব্যাপারে আলেমগন নিম্নরূপ উক্তি করেছেনঃ-

     ১। যে সব আয়াতে ইসলামী দাওয়াত ও প্রচার কার্যের উপর অধিক জোর দেয়া হয়েছে এবং সম্বোধনের ক্ষেত্রে বিশেষ বিনম্রতা ও কোমল নীতি অবলম্বন করেছেন।

     ২। যে আয়াতে কাফেরদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের কথা উল্লেখ নেই।

    ৩। যে সব আয়াতে কঠিন কঠিন শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে।

    ৪। যে সব আয়াতে হৃদয়াবেগ ও মনস্তত্ত্বের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়েছে।

    ৫। যে সব আয়াতে তাওহীদ, কেয়ামত এবং অন্যান্য উপদেশ নসীহতের বিষয় উল্লেখ রয়েছে।

    ৬। যে সব আয়াতে আদম (আ) এবং ইবলিশের কাহিনী বিবৃত হয়েছে।

    ৭। যে সব আয়াতে  ইবাদত ও কাজের বাস্তব নির্দেশ কম।

    ৮। যে সব আয়াতে আকীদা ও মতাদর্শ সম্পর্কীয় আলোচনা করা হয়েছে।

    ৯। যে আয়াতে ইহুদী ও নাসারাদের সাথে কোন বিতর্কের উল্লেখ নেই।

   ১০। মাক্কী আয়াত সমুহ ছোট ছোট।

   ১১। মাক্কী আয়াত সমুহে অধিকাংশ ক্ষেত্রে "হে মানুষ" বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

  ১২। যে আয়াতের ভাষা স্বচ্ছ, রচনাশৈলী নিরূপম যা অত্যন্ত আকর্ষনীয় এবং অতি উন্নত সাহিত্যরসে ভরপুর।

  ১৩। যে আয়াতে শরীয়তের ব্যাপারে কোন আলোচনা নেই।

  ১৪। যেসব আয়াতে পুর্ববর্তী নবীদের ঘটনা ও অতীত যুগের মানব জাতীর ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

মাদানী আয়াতের পরিচয়ঃ-

 মাদানী আয়াতের পরিচয়ের আলেমদের উক্তি নিম্নরূপ-

   ১। যে সব আয়াতে চিন্তার গভীরতা, ব্যাপকতা ও তীক্ষতা বিরাজমান সেগুলো মাদানী আয়াত।

   ২। যে সব আয়াতে ইসলামের প্রচার কার্যের সঙ্গে সঙ্গে কাফেরদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ করার নির্দেশও রয়েছে।

   ৩। যে সব আয়াতে আদেশ, আইন, ও কাজের সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।

   ৪। যে সব আয়াতে ইবাদত এবং আল্লাহর হুকুম পালনের নির্দেশ রয়েছে।

   ৫। যে সব আয়াত সাধারনত দীর্ঘ।

   ৬। যেসব আয়াতের শব্দাবলী প্রায়ই আইনানুগ সে গুলো মাদানী।

   ৭। যেসব আয়াতে আহলে কিতাবদের সাথে রীতিমত বিতর্কের উল্লেখ রয়েছে।

   ৮। যেসব আয়াতে মানুষকে সম্বোধন করা হয়েছে "হে মুমিনগণ" বলে। মাত্র সাতটি আয়াত এর ব্যতিক্রম।

   ৯। যেসব আয়াতে হদ বা দন্ডবিধির কথা উল্লেখ আছে।

   ১০। যে সব আয়াতে জয়-পরাজয়, বিপদাপদ, নিরাপত্তা, বিপন্নতা ইত্যাদি অবস্থায় মুসলমানদের কর্তব্য প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।

   ১১। যেসব আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা করা হয়েছে সে গুলো প্রায়শই মাদানী।

   ১২। যেসব আয়াতে সমাজ গঠনের বিধান সংক্রান্ত আলোচনা করা হয়েছে।

   ১৩।যেসব আয়াতে বিবাহ, তালাক, যাকাত, হজ্জ, ফারায়েয ইত্যাদি শরীয়তের বিধানাবলির বর্ণনা রয়েছে।

   ১৪। যেসব আয়াতে আহলে কিতাব, সন্ধি, যিম্মি, ইত্যাদি সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে।

আল-কোরআন ও  আল-হাদীসের মধ্যে পার্থক্যঃ-

     আল-কুরআন এবং আল-হাদীছ ইসলামী জীবন-বিধানের মৌলিক উৎস। অবশ্য আল-কোরআন ইসলামী শরীয়তের প্রধান উৎস। তবে কুরআন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ভাব-ভাষা এবং মর্ম সম্বলিত। আর হাদীছ আল্লাহর পরোক্ষ ইংগিত, যা রাসুল (স)-এর ভাষায় প্রকাশিত। উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য নিম্নে দেওয়া হলো-

    ১। কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ অহী বা প্রত্যাদেশ। আর হাদীছ আল্লাহর রাসুলের প্রতি পরোক্ষ অহী।

    ২। কুরআন জিব্রাইল আমীনের মাধ্যমের রাসুলের নিকট অবতীর্ণ। আর হাদীছ অপ্রকাশ্য প্রত্যাদেশরূপে সরাসরি রাসুলের নিকট অবতীর্ণ।

    ৩। কুরআনের ভাব ও ভাষা আল্লাহর নিজের। আর হাদীছের ভাব ও মর্ম আল্লাহর, কিন্তূ ভাষা রাসুলের নিজের।

    ৪। কুরআন "ওহী মাতলু" বা পঠিত প্রত্যাদেশ। আর হাদীছ "ওহী গাইরে মাতলু" বা অপঠিত প্রত্যাদেশ।

    ৫। নামাযে কুরআন পাঠ করা ফরয। আর হাদীছ পাঠ করা যায় না।

সাত কিরাআত ও দশ কিরাআতের পরিচয়ঃ-

   কুরআন মাজীদের কালেমাগুলো উচ্চারণ ও তা আদায়ের সঠিক পদ্ধতিকে কেরাআত বলে। সাত কেরাআত, দশ কেরাআত বলতে প্রসিদ্ধ ৭/১০ জন কারীর প্রতি সম্পর্কিত কেরাআতকে বুঝায়।

     সকল আলেমের ইজমা হল, কুরআন হিসেবে গ্রহনযোগ্য হওয়ার জন্য কোন কেরাআতের মাঝে তিনটি শর্ত পাওয়া জরুরী। যথা-  

    ১। হুজুর (স) থেকে বিশুদ্ধ সুত্রে প্রমাণিত হওয়া।

   ২। আরবী হরফ ও নাহুর আইন অনুযায়ী হওয়া।

   ৩। মাসহাফে উসমানীর লিখন পদ্ধতির মাঝে এর সংকুলান হওয়া।

   আল্লামা তাকী উসমানী স্বীয় উলুমুল কোরআন গ্রন্থে লিখেন-এ তিন শর্ত সাপেক্ষে অনেকগুলো কেরাত পাওয়া যাওয়ায় এক ইমাম এক বা একাধিক কেরাত গ্রহন করে তা শিক্ষা দিতে লাগলো। ফলে সেই কেরাতটি সেই ইমামের নামে প্রসিদ্ধ হয়ে গেল।

    বিশেষ করে সাতজন কারীর কেরাত অন্য কেরাতের মোকাবিলায় অনেক বেশি প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে। যাদের কেরাতকে আব্বাস ইবনে মুজাহিদ স্বীয় কিতাবে একত্রিত করেন।

   আল্লামা শাজাঈ (রহ) এবং আবু বকর ইবনে মিহরান (রহ) সাত কিরাতের পরিবর্তে দশ কেরাত এক কিতাবে জমা করেন। সেখানে উক্ত সাতকিরাত ছাড়াও আরো তিনটি শামিল করেন।

ক্বারীদের পরিচয়ঃ-

প্রসিদ্ধ সাতজন ক্বারীর পরিচয়ঃ

   ১। আবদুল্লাহ ইবনে কাহীর আদ দারামী (মৃত্যু ১২০ হিঃ)। তিনি হযরত আনাস, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, এবং আবু আইয়ুব আনসারী (রা)-এর সাক্ষাৎ পান। তার কিরাত বেশি প্রসিদ্ধ লাভ করেছে মক্কায়। তার কিরাতের ক্বারীদের মধ্যে বাযযী ও কুমকুম বেশী প্রসিদ্ধ।

   ২। নাফি ইবনে আবদুর রহমান (মৃত্যু ১৫৯ হিঃ)। তিনি ৭০ জন এমন কারী হতে উপকৃত হন, যারা সরাসরি উবাই ইবনে কা'ব, ইবনে আব্বাস, ও আবু হুরায়রা (রা)-এর ছাত্র ছিলেন। তার কেরাত মদীনায় বেশি প্রসিদ্ধ লাভ করে। তার থেকে বর্ণনাকারীদের মধ্যে আবু মুসা কালুন ও আবু সাঈদ ওরশ বেশি প্রসিদ্ধ।

   ৩। আবদুল্লাহ ইবনে আমের দামেস্কী (মৃত্যু ১১৮ হিঃ)। তিনি সাহাবীদের মধ্যে নোমান বিন বশীর, ওয়াছেলাহ ইবনে আসকাহ (রা)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। তিনি কিরাতের ব্যপারে মুগীরা বিন শিহাব হতে উপকৃত হন। যিনি সরাসরি উসমান এর ছাত্র। তার কিরাত শাম দেশে প্রসিদ্ধ লাভ করে।

   ৪। আবু আমর যিয়াদ বিন আলা (মৃত্যু ১৫৪ হিঃ)। তিনি মুজাহিদ ও সাঈদ বিন যোবায়ের (রা)-এর ছাত্র ছিলেন, যারা সরাসরি ইবনে আব্বাস ও উবাই বিন কা'ব হতে কিরাত শিখেছেন। তার কিরাত বসরায় বেশি প্রসিদ্ধ ছিল।

   ৫। হামযা বিন হাবীব (মৃত্যু ১৮৮ হিঃ)। তিনি সুলাইমান আল আমাশের ছাত্র ছিলেন। যিনি সরাসরি হযরত উসমান, আলী ও ইবনে মাসউদ (রা)-এর ছাত্র ছিলেন। তার কিরাত কুফায় বেশি প্রসিদ্ধ ছিল।

   ৬। আসিম বিন আবিন নাজুদ (মৃত্যু ১২৭ হিঃ)। তিনি ঝির বিন হুবাইশের মাধ্যমে ইবনে মাসউদের এবং আবু আবদুর রহমানের মাধ্যমে হযরত আলী (রা)-এর ছাত্র ছিলেন। তার কিরাত বর্ণনাকারীদের মধ্যে হাফস ও শোবা প্রসিদ্ধ। বর্তমানে সাধারনত হাফসের বর্ণনা অনুযায়ী তেলাওয়াত করা হয়।

   ৭। আলী বিন হামযা আল কাসায়ী (মৃত্যু ১৮৯ হিঃ)। তার কিরাত কুফাতে প্রসিদ্ধ ছিল।

এ সাতজন ক্বারী ব্যতীত আরো তিনজন ক্বারী আছে। যাদের কিরাতও সহীহ হিসাবে বিদ্যমান।

    ১। ইয়াকুব বিন ইসহাক (মৃত্যু ২০৫ হিঃ)। তিনি সালাম ইবনে সুলাইমান থেকে উপকৃত হন। বসরাতে তার কিরাত প্রসিদ্ধ ছিল।

   ২। খালফ বিন হিশাম (মৃত্যু ২২৯ হিঃ)। তিনি সুলাইমান বি ঈসা হতে উপকৃত হন। কুফাতে তার কিরাত প্রসিদ্ধ ছিল।

   ৩। আবু জাফর ইয়াজিদ ইবনে কা'কা (মৃত্যু ১৩০ হিঃ)। তিনি ইবনে আব্বাস, আবু হুরায়রা ও উবাই (রা)-থেকে উপকৃত হন। তার কিরাত মদীনায় প্রচলিত ছিল।

মোটকথা সাত বা দশ কিরাত বলতে ৭/১০ ক্বারীর আলাদা আলাদা পঠন পদ্ধতিকে বুঝায়। তবে এটা আবশ্যক নয় যে, প্রত্যেক কালেমায় এরূপ পার্থক্য হয়েছে। বরং কোথাও ২, কোথাও ৩,বা ৪ কিরাত পাওয়া যায়।

আল-কোরআনের অনুবাদকে কি কুরআন বলা যায়ঃ-

     আল-কুরআনের অনুবাদকে কি বলা যায় এ ব্যাপারে মুফাসসিরগণ বলেছেন-কুরআনের অনুবাদকে কুরআন বলা যায় না। কেননা আল্লাহ বলেছেন- "আমি একে আরবী ভাষায় কোরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার"(ইউসুফ ২)। তাই যে ভাষায় যে রূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সেটাই কুরআন। কোরআনের অনুবাদকে বলতে হবে "কুরআনের অনুবাদ।" আর কুরআনের তাফসীরকে বলা হবে "কুরআনের তাফসীর"।

আল-কুরআন কি নিছক ধর্ম গ্রন্থঃ-

     কুরআন মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ নয় এবং এটি আদৌ কোনো ধর্ম গ্রন্থই নয়। কুরআন আল্লাহর কিতাব। এটি তিনি পাঠিয়েছেন "যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী"(বাকারা ১৮৫)। কুরআন ধর্ম, বর্ণ, বংশ, গোত্র, জাতি, উপজাতি নির্বিশেষে সকল মানুষের গ্রন্থ। আল্লাহ বলেছেন-"আমি আপনার প্রতি সত্য ধর্মসহ কিতাব নাযিল করেছি মানুষের কল্যাণকল্পে। অতঃপর যে সৎপথে আসে, সে নিজের কল্যাণের জন্যেই আসে, আর যে পথভ্রষ্ট হয়, সে নিজেরই অনিষ্টের জন্যে পথভ্রষ্ট হয়। আপনি তাদের জন্যে দায়ী নন"(যুমার।৪১)। আল্লাহ আরো বলেছেন আল-ইমরানের ১৩৮ নাম্বার আয়াতে-"এই হলো মানুষের জন্য বর্ণনা। আর যারা ভয় করে তাদের জন্য উপদেশবাণী।"

    সুতরাং কুরআনের উপর মুসলমানদের একচ্ছত্র অধিকার নেই, কুরআনের উপর অধিকার রয়েছে সকল মানুষের।

তিলাওয়াতে সিজদাঃ-

     কুরআন মাজিদে বেশ কয়েকটি আয়াত আছে, যে গুলো পাঠ করে মহান আল্লাহকে সিজদা করা জরুরী। সে গুলোকে সিজদার আয়াত বলা হয়।

তিলাওয়াতের সিজদা ১৫টি। আয়াত পাঠ শেষ হবার সাথে সাথেই সিজদা করা উত্তম। কোন কারণে সাথে সাথে সম্ভব না হলে প্রথম সুযোগেই করে নিতে হবে। ইহা ফরয নয়,ইমাম আবু হানিফার মতে ওয়াজিব,অন্যদের মতে সুন্নাত। এই সিজদা অযু ব্যতীত ও করা যায়েজ আছে।

আল-কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সুরাঃ-

    ওলামায়ে মুফাসসিরগন আল-কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরার সম্পর্কে মতবিরোধ করেছেন-

   ১। ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) প্রখ্যাত সাহাবী বারা ইবনে আযেব (রা) থেকে বর্ণনা করেন, আল-কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা হল সূরা তাওবা।

   ২। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, সর্বশেষ যে সুরা নাযিল হয় তা হল সূরা নাসর।

   ৩। হযরত আয়েশা (রা)-এর মতে, সর্বশেষ নাযিলকৃত সূরা হল মায়েদা।

   ৪। হযরত ওসমান (রা)-এর মতে, সর্বশেষ সুরা হল সূরা তাওবা।

   ৫।আবদুল্লাহ ইবনে ওমর-এর মতে, সূরা মায়েদা ও নাসর হল সর্বশেষ নাযিলকৃত সূরা।

মোটকথা সর্বশেষ আনেকেই বিচার বিশ্লেষন করে বলেছেন সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা হল সুরা নাসর।

শেষকথাঃ-

      মহান আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির পথ প্রদর্শনার্থে সর্বশেষ রাসুল হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উপর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল-কোরআন নাযিল করেছেন। ইহা মানব জীবনের সংবিধান।"আল্লাহর আইন চাই, সৎলোকের শাসন চাই" আজকের বিশ্বজুড়ে অশান্তির মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র শ্লোগান।আল্লাহর আইন তথা আল কুরআনকে বুঝা ও অন্যকে বুঝানোর এবং এর আলোকে নিজকে ও অপরকে সৎলোক অর্থাৎ আল্লাহর গোলাম হিসেবে তৈরী করার দায়িত্ব প্রত্যেকটি মানুষের জন্য অপরিহার্য।বস্তুত আমরা যারা কলেমা পড়েছি তারাতো এ দায়িত্ব পালনেরি শপথ করেছি।এ দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই  সাহাবাগন অনেক ত্যাগ স্বীকার করে তা সংরক্ষন ও সংকলনের মাধ্যমে আজ আমাদের নিকট সুন্দর ভাবে পৌছেছে। আজকের বিশ্বে প্রায় ৪০টির ও বেশী ভাষায় প্রনীত হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত নামায ইহা ছাড়া শুদ্ধ হয় না। তাই এই কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। রাসুল (স) বলেছেন-"তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়।" অবশ্যয় কুরআন শিক্ষার নিয়ম হল অর্থ ও ব্যাখ্যা সহকারে আয়াত মুখস্থ করে নেয়া। সাহাবায়ে কেরাম গনের শিক্ষা পদ্ধতি ও এই রকম ছিল। তাই আমাদের কুরআনের আয়াত মুখস্থ করার ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। কারণ গ্রন্থগত বিদ্যা কোন কাজে আসেনা যতক্ষন তা বুকে ধারন করা না হয়।
লিখক  নুর হোসাইন।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: