তাযকিয়া ও ইহসান

তাযকিয়া বলা হয় অন্তরের পবিত্রতাকে। অর্থাৎ মানুষের চিন্তা চেতনাকে নির্লজ্জতা আর দুনিয়াবি লোভ লালসা থেকে পবিত্র করে তাতে ওয়াসাল্লামকে ভয় আর আল্লাহর মুহাব্বাত সৃষ্টি করে দেওয়া। সাধারণত মানুষের মনের আকর্ষণ সেই সব বস্তু গুলোর প্রতি বেশি থাকে যেগুলো শরিয়তে নিষিদ্ধ, আর যেসব জিনিষ গুলোতে নফস মজা পাই। সেই সব জিনিস এর দিক থেকে মানুষের অন্তরকে মোড় ঘুরিয়ে হেদায়েত আর নেকীর দিকে নিয়ে আসার মেহনতকেই বলা হয় তাছাওউফ বা ছুলুক বা তাযকিয়ায়ে নফস। তাসাওউফ, সুলুক আর তাযকিয়ায়ে নফস সব একই জিনিষ। যখন অন্তর পবিত্র হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তালার প্রতি অন্তরের আকর্ষণ বাড়বে। আল্লাহ তালার নৈকট্য লাভ করা অন্তরের শুদ্ধতার উপর নির্ভরশীল।

শেখুল হাদিস আল্লামা জাকারিয়া [রহঃ] এর কাছে একজন জিজ্ঞেস করলেন তাসাওউফ কি? তখন তিনি বললেন তাসাওউফের শুরু …” إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، …….. নিশ্চয় আমলের গ্রহণ যোগ্যতা নিয়তের উপর নির্ভরশীল । আর শেষ … أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّك تَرَاهُ،……..আল্লার ইবাদত এইভাবে কর যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ, এর উপর। দৃশ্যত এখানে শুধু দুটি বাক্য। কিন্তু তাসাওউফের মুল বিষয় এখানে বর্ণনা করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যতই আমল করুক না কেন, যদি নিয়ত শুদ্ধ না হয় তাহলে কোনও আমলই ফায়দা দেবেনা। তাই তাসাওউফের ছাত্রকে সর্ব প্রথম নিয়ত শুদ্ধ করার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়। এখান থেকেই তার সফরের শুরু। যখন নিয়ত শুদ্ধ হয়ে যায় তখন আল্লাহ তালার রহমত অবতীর্ণ হতে থাকে। মারেফাতের এই রাস্তা মানুষকে সেই স্তরে পৌঁছে দেয় যেন সে ইবাদত করার সময় আল্লাহ তালাকে দেখতে পাচ্ছে। যখন কেও এই স্তরে উপনীত হয় তখন তার চরিত্র সুন্দর, মর্জি, প্রশংসনীয় হয়ে যায়।

পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণ করার সময় হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আ. ও হযরত ইসমাঈল আ. আল্লাহ তাআলার দরবারে এ দুআও করেছিলেন যে : ‘‘হে আমাদের রব! তাদের নিকট তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের সামনে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন।’’-সূরা বাকারা : ১২৯

উপরোক্ত আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রিসালাতের তিনটি উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে : এক. আয়াত পাঠ করা, দুই. কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেওয়া ও তিন. মানুষের স্বভাব-চরিত্রের তাযকিয়া করা।

তাযকিয়ার অর্থ হচ্ছে, বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করা। বাহ্যিক অপবিত্রতার অর্থ তো সাধারণ মুসলমানেরও জানা আছে। আর আত্মিক অপবিত্রতা হচ্ছে, কুফর, শিরক, গায়রুল্লাহর উপর ভরসা, ভুল আকিদা-বিশ্বাস এমনিভাবে অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, দুনিয়ার মোহ ইত্যাদি।

কুরআন কারীমে বারংবার ইরশাদ করা হয়েছে যে, উম্মাতের ‘তাযকিয়া’ই রাসূলুল্লাহ -এর মূল মিশন । মহান আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসুল প্রেরণ করেছেন, তিনি আল্লাহর আয়াত তাদের নিকট আবৃত্তি করেন, তাদেরকে ‘তাযকিয়া’ (পরিশোধন) করেন এবং কিতাব ও প্রজ্ঞা (সুন্নাত) শিক্ষা দেন।”

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণের উদ্দেশ্যের মধ্যে আল্লাহ তালা এটাও বলেছেন যে তিনি উম্মতের আত্মশুদ্ধি করবেন।

هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ

তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত। সুরা জুমুআহ = আয়াত, ২

অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে : “সেই সফলকাম হবে, যে নিজেকে ‘তাযকিয়া’ (পবিত্র) করবে এবং সেই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।”

‘তাযকিয়ায়ে নাফস’-ই সফলতার মূল। আল্লাহ তাআলা বলেন :

قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّى

‘‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয় ।’’ (সুরা আ,লা= আয়াত ১৪ )

قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا

‘‘যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।’’ (সুরা- আশ-শামস= আয়াত ৯,১০ )

এই দুটি আয়াতের দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝা যায় কল্যাণ আর সফলতা তাযকিয়ায়ে নফসের সাথে সম্পর্কিত। দিল বা অন্তর পাক পবিত্র থাকলেই নেক কাজ করা যায়। যাতে নিহিত রয়েছে দুনিয়াবি ইজ্জত, মানসিক প্রশান্তি আর পরকালিন নেয়ামত, তথা জান্নাতের চিরস্থায়ী জীবন। সর্বোপরি আল্লাহ তালার সন্তুষ্টি।

আরো বলা হয়েছে : “নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে যে ‘যাকাত’(পবিত্রতা) অর্জন করে। এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও সালাত আদায় করে।”

আল্লাহর আনুগত্য, ইখলাসা ও নির্ভেজাল তাওহীদের মাধ্যমে তাদের তাযকিয়া করেন। তাবিয়ী ইবনু জুরাইজ বলেন : ‘‘তিনি তাদেরকে শিরক থেকে পবিত্র করেন।) মুমিনগণকে শিরক ও গাইরুল্লাহর ইবাদত থেকে পবিত্র করেন এবং আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।’’

সাহাবী-তাবিয়ীগণও এভাবেই আয়াতগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন রাসূলুল্লাহ ‘তাযকিয়া’-র ব্যাখ্যায় ইমাম তাবারী বলেন, তাযকিয়া শব্দটি ‘যাকাত’ থেকে গৃহীত। যাকাত অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। এ সকল আয়াতে ‘তাযকিয়া’ অর্থও পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। রাসূলুল্লাহ (এভাবে আমরা দেখছি যে, দীনের সকল কর্মই ‘তাযকিয়া’-র অন্তর্ভুক্ত; কারণ সকল কর্মই মুমিনকে কোনো না কোনোভাবে পবিত্র করে এবং তার সাওয়াব, মর্যাদা ও পবিত্রতা বৃদ্ধি করে। তবে এক্ষেত্রে হার্দিক বা মানসিক বিষয়গুলির প্রতি কুরআন ও হাদীসে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কুরআনকে সকল মনোরোগের চিকিৎসা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : “হে মানব জাতি, তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে এসেছে উপদেশ এবং তোমাদের অন্তরে যা আছে তার চিকিৎসা।”

হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ বলেন : “জেনে রাখ! দেহের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ড রয়েছে, যদি সংশোধিত হয় তবে পুরো দেহই সংশোধিত হয় আর যদি তা নষ্ট হয় তবে পুরো দেহই নষ্ট হয়। জেনে রাখ তা অন্তঃকরণ।”

এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, উপরে বেলায়াতের পথের যে ৮ পর্যায়ের কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলিই তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধির পর্যায় ও কর্ম। আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রেও ফরয ও নফল এবং করণীয় ও বর্জনীয় কর্ম রয়েছে। মনকে শিরক, কুফর, আত্মপ্রেম, কুরআন-সুন্নাহের বিপরীতে নিজের পছন্দকে গুরুত্ব প্রদান, হিংসা, অহঙ্কার, লোভ, রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি থেকে হৃদয়কে মুক্ত ও পবিত্র করতে হবে। এগুলি বর্জনীয় মানসিক কর্ম। মনকে ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, আল্লাহ-ভীতি, আল্লাহর রহমতের আশা, আল্লাহর ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্টি, নির্লোভতা, সকলের প্রতি ভালবাসা, কল্যাণকামনা ইত্যাদি বিষয় দিয়ে পরিপূর্ণ করতে হবে। এগুলি করণীয় মানসিক কর্ম। এগুলির ফরয ও নফল পর্যায় আছে। এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, র্শিক, আত্মপ্রেম ইত্যাদিতে মন ভরে রেখে পাশাপাশি সবর, শোকর, ক্রন্দন ইত্যাদি গুণ অর্জনের চেষ্টা করা বিভ্রান্তি ও ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: