তাসাউফের ক্রমবিকাশ

ইলমে মারফত বা তাসাউফ পৃথীবির আদিম একটি বাতেনী মৌলিক জ্ঞান যা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ) কে নিজে শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন এ আছে : “আর তিনি (আল্লাহ্‌) আদমকে সব বস্তুর নামের জ্ঞান দেয়ার পর ফেরেশতাদের সামনে হাজির করলেন।” (সূরা বাকারাঃ ৩১) এই মহা জ্ঞান (তাসাউফ বা মারফতের জ্ঞান) এর মাধ্যমেই আদম (আঃ) ফেরেশতাদের তথা সৃষ্ঠিকুলের স্রেষ্টত্ব অর্জন করেছিলেন।

 

পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর পৃথিবীতে আগমনের সময় থেকে তাসাউফের উত্পত্তি ঘটে। প্রায় চার শতাব্দীকাল যাবত্ তিনি তাসাউফের সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। বংশ পরম্পরায় হযরত হাবিল আলাইহিস সালাম, হযরত শীষ আলাইহিস সালাম, হযরত নূহ আলাইহিস সালাম, হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম প্রমুখ নবীর মাধ্যমে তাসাউফ বিকশিত হতে থাকে এবং হাবীবুল্লাহ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়।

রাসূলের যুগে : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবদ্দশায় এর সূত্রপাত ঘটে। রাসূল (সঃ) ১৪ বছর হেরা পাহারের গুহায় মোরাকাবা মোসাহেদার মাধ্যমে এ জ্ঞান চর্চা করতেন। এই জ্ঞানের দ্বারই কোরআণ শরীফ নাজিল হয়েছে। তাই তাসাউফ চর্চা একটি সুন্নত। পরবর্তীতে কর্মময় তেইশ বছরের নবুয়াতি জিন্দিগীতে অসংখ্যবার তন্ময়তা-ধ্যান মগ্নতায় তিনি অনন্য হয়ে ওঠেন। রাসূল (সঃ) এর আমলে তার একদল সাহাবী মসজিদ এ নববীর বারান্দায় থাকতেন এবং সবসময় মোরাকাবা, মোশাহেদা এবং জিকির আসগর করতেন। সমস্ত রাত তাহাজ্জুদ বন্দেগী ও রহমত এর ফায়েজ জিকির করতেন। এ সকল সাহাবাদরে সাথ হযরত রসুল করীম (সঃ) আল্লাহ তালার রহস্য সম্পর্ক আলোচনা করতেন যা আরবদের বড় বড় তত্ত্বজ্ঞানী ও সাধারণ সাহাবাগণ বুঝত সক্ষম হতেন না। রাসূল (সঃ) এই সকল সাহাবীদের আল্লাহর প্রতি বিশেষ বন্দেগী ও তাসাউফ চর্চায় মুগ্ধ হয়ে রাসূল (সঃ) এর ব্যবহারিত পশমি চাদর বা কাপড় উপহার দিতেন। তাদের কে সূফী বলা হত।

রাসূল (সঃ) এর সাহাবীগনরা তাসাউফ চর্চা করতেন এবং রাসূল (সঃ) এর কাছ থেকে অধিক ইলম লাভ করতেন। রাসূল (সঃ) এর মেরাজ গমন এর কথা সর্বপ্রথম হযরত আবুবকর (রাঃ) তার মারফত জ্ঞান এর মাধ্যমেই বিশ্বাস করেছিলেন। অন্যান্য সাহাবিদের নিকট হুদায়বিয়ার সন্ধি নিশ্চিত পরাজয় বলে বিবেচিত হলেও হযরত আবুবকর (রাঃ) এর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মাধমে সন্ধির নিগুঢ় বিজয় এর তত্ব, দৃষ্টিতে এসেছিল। হযরত আলী (রাঃ) এর সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেন : “আমি রাসূল (সঃ) আধ্যাত্মিক এলমের নগরী, আলী (রাঃ) যার দরজা”।

হযরত আলী (রাঃ) নামাজে এমন মোরাকাবায় নিমজ্জিত থাকতেন যে, যুদ্ধ চলাকালিন বিদ্ধ একটি তীর বের করা হলে আলী (রাঃ) সামান্য টুকু অনুভব করতে পারেন নাই। ইহা হল তাসাউফ এর দায়রায়ে হাকিকত সালাতের জজ্‌বাহ। পৃথিবীর প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বেলাল (রাঃ) তাসাউফ জ্ঞানের প্রভাবে এমন ছিলেন যে- রাসূল (সঃ) এর মৃত্যুর পর আজান দিতেন না তবে একদিন সমস্ত সাহাবীগনদের অনুরোধে আজানে “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্‌ (সঃ)” বলার পরেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন এবং এই অজ্ঞানেই তার মৃত্যু হয়। এসমস্ত মুহাব্বতের ফায়েজ ও জজ্‌বাহ্‌ তাসাউফ এর জ্ঞানের মাধ্যমেই আসে।

খোলাফায়ে রাশেদার যুগে : হযরত রসুল করিম (সঃ) এর মাঝে নবুয়ত পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় এবং তাঁর ওফাতের সাথে সাথে নবী প্রেরণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বেলায়তী শক্তির প্রবাহ হযরত নবী করিম (সঃ) অব্যাহত রেখে যান। যেহেতু কাফেরদের উদ্যত রোষ থেকে হযরত রসুল (সঃ)-কে রক্ষা করার মানসে হযরত রসুল করিম (সঃ)-এর পবিত্র বিছানায় শুয়ে থেকে আত্মোৎসর্গের কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় হযরত আলী (রাঃ) উত্তীর্ণ হন, সেই হেতু হযরত আলী(রাঃ) হযরত রসূল করিম (সঃ)-এর বেলায়তী শক্তি বা এলমে তাসাউফের উত্তরাধিকারী হন বলে স্বীকৃত ধারণা।

রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের যাহিরি বা বাহ্যিক শিক্ষা সকল সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকেই দিয়েছেন। তাদেরকে অন্তর পবিত্র ও শুদ্ধ করার শিক্ষা দিয়েছেন। বিশেষ করে এ শিক্ষা পেয়েছেন হযরত আবু বকর, হযরত ওমর, হযরত উসমান ও হযরত ‘আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সহ পৃথিবীতেই জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া দশজন সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ। পরবর্তীতে হযরত আবু বকর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সূত্রে সালমান আল ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সূত্রে হাসান আল-বসরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলামী জীবণাচারের বাতেনী এ দিক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। এভাবেই তাসাউফের শিক্ষা বিস্তৃত হয়।

খলীফাগণ বিরাট সাম্রাজ্যের মালিক হয়েও পার্থিব সুখ-শান্তি কামনা করতেন না তাঁরা আল্লাহর চিন্তায় ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তাদের অনুসরণ করে একদল সাহাবী ও তাবেঈ মোরাকাবা ও মোশাহাদায় সর্বদা লিপ্ত থাকতেন। সাহাবীদের মধ্যে ইবন মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাসাউফের ক্রমবিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

উমাইয়া শাসনামলে সুফীবাদ : উমাইয়া শাসনামলে সুফীবাদের চরম উৎকর্ষ সাধন হয়। এ সময়ে কয়েকজন সুফী আল্লাহর ধ্যান-ধারণাকেই জীবনে চরম ও পরম ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। এ সকল ধর্মতাপশদের মধ্যে ইমাম হাসান আল-বসরী, হযরত আবুল হাশিম কুফী, জাবির ইবনে হাইয়ান, হযরত রাবেয়া বসরী, ইব্রাহিম ইবনে আদহাম, মারূফ আল-কারখী রহমতুল্লাহি আলাইহিমগন তাসাউফের স্বতন্ত্র ধারার সূচনা করেন। শুরু হয় কৃচ্ছ্রতা সাধনার মাধ্যমে তাসাউফ সাধনার নতুন যুগের।

আব্বাসীয় শাসনামলে সুফীবাদ : আব্বাসীয় শাসনামলে সুফী মতবাদ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে থাকে এ যুগকে ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এ যুগে সুফী মতবাদের ওপর বিদেশী প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এক পর্যায়ে সুফীদের মধ্যে দু’টি দলের সৃষ্টি হয়।

ক. ইনকিশাফী দল : এদলে পুরোধা ছিলেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহ., জুনায়েদ বাগদাদী রহ. প্রমুখ।

খ. ইসতিদলালী দল : এ দলের সুফীদের মধ্যে স্পেনের মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী ও রূমের মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী রহ. অন্যতম।

সূফীবাদের শেষ স্তর : ইলমে তাসাউফ চর্চায় ইমাম গাজ্জালীর খেদমত অপরিসীম। তিনি তাসাউফের ওপর অনেকগুলো বই রচনা করেন। এসব রচনার মাধ্যমে তিনি সুফীমতবাদকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

সুফীবাদের প্রথম উৎপত্তি আরবে পরে এটা ইরানে প্রসারিত হয় এবং ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করে। ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসী, সাদী, জামী, প্রমুখ সুফী ইরানেই জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর তাসাউফ ক্রমবিকাশের ব্যাপ্তি পাক-ভারত উপমহাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে। উপমহাদেশে এর খ্যাতি ও প্রসিদ্ধ আরবদেশগুলোর তুলনায় বেশি। এতে নেতৃত্ব দেন হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী রহমতুল্লাহি আলাইহি। এ যুগের অন্য শ্রেষ্ঠ সূফী ছিলেন হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি। এ সময়ে এ দেশে কাদেরিয়া, মুজাদ্দিদীয়া, নকশবন্দীয়া ও চিশতীয়া তরিকার প্রসার ঘটে। বখতীয়ার খলজী বাংলা বিজয়ের পর সূফী সাধকগণ বাংলাদেশে আসেন এবং তাদের প্রচেষ্টায় ইসলাম বিজয়ী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ের সূফীদের মধ্যে হযরত শাহজালাল, হযরত শাহ পরাণ, হযরত শাহ মাখদুম, হযরত সুলতান মাহী সাওয়ার রহমতুল্লাহি আলাইহিমগন অন্যতম।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: