মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে যে ক’জন মুসলিম কবি সাহিত্যিক ও মনীষী তাঁদের রচনায় ইসলামী সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে অমর হয়ে আছেন তন্মধ্যে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীও শীর্ষ স্থানীয়দের অন্যতম একজন। তিনি আধুনিক ইরানের একটি সুপরিচিত নাম। শুধু ইরানের কেন আধুনিক বিশ্বেরও। তিনি শুধু কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আধুনিক আধ্যাত্মিক চিন্তা চর্চার সাধক। দর্শন ও বিশ্বসাহিত্যের একজন অগাধ পান্ডিত্যপূর্ণ মনীষী।
মাওলানা রুমী সাহিত্যচর্চা করেছেন ফার্সীতে। তিনি ফার্সী ভাষায় অনেক জ্ঞানগর্ভ শিক্ষামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক ও উপদেশমূলক একাধিক প্রবন্ধও আছে। তন্মধ্যে “ফিহি মা ফিহি অন্যতম। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উল্লেখযোগ্য কীর্তিমান অমরত্ব পাওয়া গ্রন্থ “মসনবী”। মসনবী শুধু ফার্সী সাহিত্য ভান্ডারে নয়। এটি বিশ্ব সাহিত্য ভান্ডারেরও একটি অমূল্য সম্পদ। এই গ্রন্থে দ্বিপদী ছন্দবদ্ধ কবিতার সংখ্যা পঁচিশ হাজার। যা ছয় খন্ডে বিভক্ত। মসনবী গ্রন্থে তিনি কাব্য আকারে বহু কাহিনী উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে। এগুলো প্রায় সবই মূল্যবান উপদেশাবলী। আমাদের দেশও মসনবী বাংলায় অনূদিত হয়েছে। শুধু তাই নয় আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনে তথা বাঙালি মুসলিম সমাজে ‘মসনবী’ ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। যার কারণে তিনি আমাদের কাছেও হয়ে আছেন একান্ত প্রিয়। মসনবীতে তিনি কোন সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের চিহ্ন রাখেননি। যে কোন ধর্মের পাঠকরাই এই গ্রন্থ থেকে পরম প্রিয় সৃষ্টিকর্তার প্রেমের অপার রহস্য উদঘাটনে তৃপ্তি লাভ করতে পারবেন। ‘মসনবী কেবল ধর্মতত্ত্বের উপর নয়, সাধারণ দর্শনের একটি আদর্শ গ্রন্থ হিসেবেও পরিচিত।’ মসনবী প্রসঙ্গে উক্ত কথাগুলো অকপটে স্বীকার করেছেন মসনবীর বৃটিশ অনুবাদক উইলসন। গ্রন্থের পরতে পরতে বর্ণিত হয়েছে মানবাত্মা ও মহাত্মার মধ্যে চিরন্তন বন্ধন ও প্রেমের কথা। এক কথায় যাকে বলা যায় “নিরঙ্কুশ আল্লাহর প্রেমে।” এতে নেই কোন বাড়াবাড়ি কিংবা ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে কোন জোরজবরদস্তি। তাই মসনবীকে এক বাক্যে বলা যায় একটি ধর্মীয় নীতিশাস্ত্র গ্রন্থ।
কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর জন্ম ১২০৫ সালের (মতান্তরে ১২০৭) ২৯ সেপ্টেম্বর, ৬০৪ হিজরীর ৬ রবিউল আউয়াল, আফগানিস্তানের বালখে। তাঁর প্রকৃতনাম মুহাম্মদ। জালালুদ্দিন ছিল তাঁর উপাধি। সুলতান মুহাম্মদ বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ ছিলেন মওলানা রুমীর পিতা। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বক্কর (রা:) ছিলেন মাওলানা রুমীর পিতৃকুল থেকে নবম বংশধর এবং মাতৃকূল থেকে ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলীর (রা:) বংশধর। তাঁর দাদা হোসাইন ইবনে আহম্মদ বালখীও ছিলেন একজন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সৌভাগ্যবান ও আধ্যাত্মিক সাধক।
১২১১ সালে মাত্র ছয় বৎসর বয়সে মাওলানা রুমী তাঁর সঙ্গে পিতার আধ্যাত্মিক ওস্তাদ খাজা ফরিদুদ্দিন আক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। তিনি রুমীকে দেখে অত্যন্ত খুশি হন। তিনি শিশু রুমীর বুদ্ধিদীপ্ত সুরত দেখে মন্তব্য করেন, অদূর ভবিষ্যতে এই শিশু সন্তান সমাজের একজন বিদ্বান হবে ও বিজ্ঞ লোকদের সচেতন আত্মাকে আলোকিত করবে। ওস্তাদ খাজা সাহেব শিশু রুমীকে তাঁর রচিত ‘গহের নামা’ কিতাবটি উপহার দেন।
মাওলানা রুমী ছিলেন একজন আলেম পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর পিতৃ মাতৃকুল ছাড়াও তাঁর বিবাহ হয় সমরখন্দের এক বিশিষ্ট আলেম কন্যার সাথে। তাঁর দাম্পত্য জীবনে প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয়। সে শ্বশুর কুলও ছিলেন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন। যৌবনের প্রারম্ভেই মওলানা রুমী জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে তৎকালীন বিভিন্ন মুসলিম দেশ সফরে বেরিয়ে পড়েন। সফরের এক পর্যায়ে তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে উপস্থিত হন এবং পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। মক্কা থেকে ফিরে তিনি তুরস্কের আনাতোলিয়া কৌনিয়ায় পৌঁছে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তখন তাঁর বয়স বাইশ। সঙ্গে তাঁর পিতাও ছিলেন। জানা যায়, তদানীন্তন রোমের বাদশাহ সুলতান আলাউদ্দীনের অনুরোধে তিনি কৌনিয়ায় আসেন। কৌনিয়ায় বাদশাহ একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্ম তত্ত্বের শিক্ষক হিসেবে রুমীর পিতা এই মাদ্রাসায় যোগ দেন। পিতার মৃত্যুর পর মাওলানা রুমী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
তিনি ৬৩০ হিজরীতে ২৪ বছর বয়সে সিরিয়ায় গমন করেন এবং হালবস্থ ছালাবিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি হাদীস, ফিকাহ, তাফসির, সাহিত্য, দর্শন, মারেফাত, তরিকত এবং অন্যান্য মতবাদ ও তত্ত্ব সম্পর্কে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করে তদানীন্তন বিশ্বখ্যাত আলেমে দ্বীন মঈনুদ্দীন ইবনে আরাবিয়া, শেখ সদরুদ্দীন কৌনভী ও শেখ ওসমান প্রমুখের সমকক্ষ হয়ে ওঠেন। উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি ৬৩৪ খৃষ্টাব্দে পুনরায় কৌনিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন।
মাওলানা রুমী ও তাঁর মসনবী যুগ-যুগ ধরে মুসলিম সমাজ তথা বিশ্ব সাহিত্য আঙিনায় দ্যুতি ছড়াবে নিঃসন্দেহে। আল্লাহ তাকে জান্নাত নছিব করুন, আমীন।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: