মাতা-পিতার অধিকার


মাতা-পিতার অনেক অধিকার রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু অধিকার নিম্নে উল্লেখ করা হল:
মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার : আল্ল¬াহ তা’আলা তাদের সাথে ভাল আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا. (بني إسرائيل : ২৩)
তোমার পালনকর্তা আদেশ করছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারো এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। (সূরা বনী-ইসরাইল-২৩)
রাসূল সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম পিতা-মাতার আনুগত্যকে সর্বোত্তম আমল এবং আল্ল¬াহর নিকট অধিক প্রিয় আমলের মাঝে গণ্য করেছেন। সাহাবী ইবনে মাসঊদ (রাঃ) নবী করীম সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬ামকে জিজ্ঞেস করলেন :
أيّ العمل أحب إلى الله؟ قال الصلاة على وقتها، قال ثم أيّ؟ قال بر الوالدين قال ثم أيّ؟ قال الجهاد في سبيل الله. (البخاري)
আল্ল¬াহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি? তিনি বললেন, সময় মত নামাজ পড়া। তিনি বললেন, অত:পর কোনটি? বললেন, পিতা-মাতার আনুগত্য করা। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্ল¬াহর রাস্তায় জিহাদ করা। (বুখারী)
পবিত্র কুরআন এবং রাসূলের হাদীস পিতা-মাতার প্রতি সুন্দর আচরণের নির্দেশ দেয়। আল্ল¬াহ তা’আলা ইরশাদ করেন :
وصاحبهما في الدنيا معروفا (اللقمان-১৫)
এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহ অবস্থান করবে। (সূরা লোকমান-১৫)
নবী করীম সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬ামকে প্রশ্ন করা হল :
من أحق الناس بحسن صحابتي؟ قال أمّك قال ثم من؟ قال أمّك، قال ثم من؟ قال أمّك، قال ثم من؟ قال أبوك. (البخاري)
আমার উত্তম ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, তোমার মা। অত:পর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। তারপর কে? তিনি বললেন: তোমার মা, তিনি আবারো জিজ্ঞেস করলেন : তারপর কে? রাসূলুল্ল-াহ বললেন: তোমার পিতা। (বুখারী)
রাসূল সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম মাতা-পিতার অবাধ্য হতে বারণ করেছেন এবং বলেছেন এটি কবীরা গোনাহ। রাসূল সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেন :
ألا أنبئكم بأكبر الكبائر؟ قلنا بلى يا رسول الله، قال الإشراك بالله، وعقوق الوالدين وكان متكئاً فجلس فقال: ألا وقول الزور، وشهادة الزور (البخاري)
আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে সংবাদ দেব না ? আমরা বললাম, হে আল্ল¬াহর রাসূল ! বলুন। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরিক করা এবং মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া। রাসূল এতক্ষণ হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। অতঃপর সোজা হয়ে বসে বললেন, সাবধান ! আর মিথ্যা বলা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া…। (বুখারী)
পিতা-মাতার অবাধ্যতা যেমন তাদের উপর রাগ করা, তাদের আনুগত্য না করা, তাদের কথায় মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, তাদেরকে ধমক দেওয়া, তাদের প্রয়োজন প্রকাশ করলে এবং কোন কথা বললে উফ বলে বিরক্তি প্রকাশ করা।
তাদের আনুগত্য করা : তাদের আদেশ-নিষেধ মানা। কিন্তু তা নিম্নোক্ত শর্তসাপেক্ষে :
(ক) আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার নির্দেশ না দেয়া।
(খ) আদেশ মান্য করার উপর সন্তানের সামর্থ্য এবং শক্তি থাকা।
তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলা :
কোন অবস্থায় চিৎকার-চেচামেচি করা যাবে না। যখন তারা কথা বলবে অথবা কিছু চাইবে তখন উঁহু বলা যাবে না। পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে এই অধিকারটির প্রতি বিশেষ যতœবান হতে হয়। আল্ল¬াহ তা’আলা ইরশাদ করেন :
﴿إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا ﴾ (الإسراء : ২৩)
তাদের মধ্য কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিওনা বরং তাদেরকে শিষ্টচার পূর্ণ কথা বল। (সূরা বনী-ইসরাইল-২৩)
পিতা-মাতার সাথে নম্র ব্যবহার এবং তাদের সামনে সংযত আচরণ :
কোন বিশেষ জ্ঞান, সম্পদ অথবা কোন পদ লাভ করার কারণে নিজেকে তাদের থেকে উঁচু মনে না করা। বরং সর্বদা মনে করবে আমি সেই ছোট সন্তান যাকে তারা কোলে তুলে নিত এবং যার ময়লা পরিষ্কার করত এবং যাকে খাওয়াত যখন সে নিজে খেতে পারত না। সে কি করে তাদের উপর বড়ত্বের দাবি করতে পারে?
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :
﴿وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ ﴾ (الإسراء : ২৪)
তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও। (বনী-ইসরাইল)
পিতা-মাতার জন্য দোয়া করা :
সন্তানের কর্তব্য হল তাঁদের জন্য জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর পর দোয়া করা।
আল্ল¬াহ তা’আলা ইরশাদ করেন :
وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا. (الإسراء : ২৪)

এবং বল : হে পালনকর্তা! তাঁদের উভয়ের প্রতি রহম কর যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। (সূরাবনী-ইসরাইল-২৪)
রাসূল সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেন :
إذا مات الإنسان انقطع عنه عمله إلا من ثلاثة: إلا من صدقة جارية، أو علم ينتفع به، أو ولد صالح يدعو له. (رواه مسلم)
মানুষ যখন মারা যায় তিনটি আমল ছাড়া সমস্ত আমলের পথ বন্ধ হয়ে যায়। চলমান দান, অথবা উপকারী ইলম, অথবা সৎ সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করতে থাকে। (মুসলিম)
পিতা-মাতাকে অভিশপ্তকরনের কারণ না হওয়া : কাউকে অভিশাপ দেয়া এমনিতেই হারাম ও অবৈধ আর এ অবৈধতার মাত্রা আরো বেড়ে যায় যদিএ অভিশাপ প্রদান , পিতা-মাতাকে অভিশপ্ত করণের কারণ হয়। রাসূল সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেন :
إن من أكبر الكبائر أن يلعن الرجل والديه، قيل يا رسول الله كيف يلعن الرجل والديه؟ قال يسب أبا الرجل فيسب أباه و يسب أمه فيسب أمه. ( البخاري)
সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ হল কোন ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেওয়া। বলা হল, হে আল্ল¬াহর রাসূল ! কোন ব্যক্তি কীভাবে নিজ পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয় ? রাসূল সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেন : কারো পিতাকে গালি দিল , আর সে তার পিতাকে গালি দিল । কারো মাতাকে গালি দিল আর সে তার মাকে গালি দিল। (বুখারী)
এ যদি হয় অবস্থা তাহলে সে ব্যক্তির অবস্থা কত মারাত্মক, যে সরাসরি নিজ পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে হেফাজত করুন।
পিতা-মাতার আত্মীয়-স্বজন এবং সাথীদের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখা, আর তাদেরকে সম্মান করা। পিতা-মাতার জীবদ্দশায় এবং তাদের মৃত্যুর পর : রাসূল সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেন :
إن من أبر البر صلة الولد أهل ود أبيه. (رواه مسلم)
সবচেয়ে বড় সৎকর্ম হল সন্তান তার পিতার বন্ধুর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। (মুসলিম)
তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া এবং প্রয়োজনে শিক্ষা দেওয়া : মানুষের মাঝে পিতা-মাতা সবচেয়ে বেশি অধিকার রাখে উপদেশ এবং সাহায্য পাওয়ার। তাদের কোন অন্যায় যে দেখবে, সে নম্রতা ও আদবের সাথে তাদেরকে সাবধান করবে। কেননা এর দ্বারা তারা শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে।
ইমাম আহমদ (রাহঃ) বলেন, যখন কোন সন্তান তার পিতাকে অপছন্দনীয় কোন কাজে দেখবে, তাকে কঠোরতা এবং খারাপ ব্যবহার ছাড়া বোঝাবে এবং কঠিন ভাষায় কথা বলবে না। নতুবা তিনি সন্তানের কথা শুনবেন না। তার সাথে অপরিচিত ব্যক্তির ন্যায় আচরণ করা চলবে না। তারপরও পিতা সন্তানের উপদেশ কখনও কখনও গ্রহণ না-ও করতে পারেন, সে জন্যে উত্তম হল, পরোক্ষভাবে অন্যের মাধ্যমে উপদেশ দেওয়া। যেমন, মসজিদের ইমামকে ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ে কথা বলতে অনুরোধ করবে, যার প্রয়োজন তার পিতার রয়েছে। অথবা পিতাকে এমন কিতাবের সন্ধান দেবে, যার মাঝে তার ভূল শুধরে দেবার উপাদান রয়েছে।
অথবা বইটি তার সামনে মেলে ধরবে, কিন্তু তাকে সতর্ক করার কথা বুঝতে দেবে না। তাহলে তিনি হয়তো তা পড়া এবং গ্রহণ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এছাড়া অন্য যে কোন মাধ্যম অবলম্বন করতে পারে, যার দ্বারা তার উপকার হয়। কোন অবস্থায় সরাসরি তাকে উদ্দেশ্য করবে না। কেননা এর দ্বারা হতে পারে তিনি দূরে সরে যাবেন।
তাদের সঙ্গ ও সাহচর্য লাভ করা : এটা সন্তান এবং পিতা-মাতার মাঝে সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির জন্যে কাম্য। এর অনেকগুলো মাধ্যম রয়েছে। তার কিছু নিম্নে উল্লেখ করা হল।
(ক) সর্বদা তাদের সাথে পরামর্শ করা এবং তাদের মতামত গ্রহণ করা।
(খ) তাদেরকে উপহার দেওয়া। রাসূল সাল্ল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেন : তোমরা পরস্পর উপহার বিনিময় কর,তাতে ভালোবাসা সুদৃঢ় হবে। (মুআত্তা মালেক)
(গ) ভ্রমণে তাদের সঙ্গ দেবে ইত্যাদি। আর এটা আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : এবং দুনিয়াতে পিতা-মাতার সাথে সদ্ভাবে সহ-অবস্থান করবে। (সূরা লোকমান-)
কতিপয় জরুরি আদব : সন্তানের উচিত পিতা-মাতার কাউকে নাম ধরে না ডাকা। তাঁদের বসার পূর্বে না বসা, তাদের সামনে দিয়ে না হাঁটা। তবে যদি তারা সামনে বাড়িয়ে দেয় তাদের কোন কষ্ট দূর করার জন্য, তাহলে কোন ক্ষতি নেই। তাদের সেবা করবে, তাদের আহ্বানে সাড়া দেবে, তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলবে। তারা কথা বলার সময় কথা বলবে না, তাদের ভূল ধরবে না অথবা বলবে না আপনি জানেন না। প্রত্যেক শরীয়তসম্মত এবং বৈধ বিষয়ে সর্বদা পিতা-মাতাকে খুশী রাখার চেষ্টা করা উচিত। তারা সন্তানদেরকে নামাযী এবং সৎ হিসাবে ভালোবাসবে এবং সৎ লোকদের সঙ্গী হিসাবে ভালোবাসবে এবং সন্তানের শিক্ষা এবং উপরে উঠার মনোভাবকে ভালোবাসবে। বরং সন্তানকে নিয়ে গর্ববোধ করবে। অতএব, উল্লে¬খিত গুণাবলী অর্জন করা পিতা-মাতার অনুগত হওয়ার শামিল।
মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়ার পরিণতি :
অবাধ্য সন্তানের দুনিয়া ও আখেরাত দুটিই ধ্বংস হয়ে যায়।
(১) মাতা-পিতার অবাধ্যতা দোজখে প্রবেশের কারণ।
(২) এতে দুনিয়া এবং আখেরাতের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে যায়।
(৩) নিজ সন্তানও অনুরূপ অবাধ্য হয়।
(৪) সমস্ত কাজে ও নিজ বয়সের বরকত নষ্ট হয়ে যায়।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: