সুরা লোকমান ১৩-১৯ আয়াত


* وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ ۖ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ﴿١٣﴾ وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَىٰ وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ ﴿١٤﴾ وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا ۖ وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿١٥﴾ يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِن تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُن فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ ﴿١٦﴾ يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا أَصَابَكَ ۖ إِنَّ ذَ‌ٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ ﴿١٧﴾ وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ ﴿١٨﴾ وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ ۚ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ ﴿١٩﴾

অনুবাদ

যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বললঃ হে বৎস, আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়। (13)

আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। (14)

পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করবো। (15)

হে বৎস, কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন। (16)

হে বৎস, নামায কায়েম কর, সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ। (17)

অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (18)

পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কন্ঠস্বর নীচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর। (19)
 

*নামকরণ
সুরার দ্বিতীয় রুকুতে অর্থাৎ আলোচ্য রুকুতে লুকমান হাকীমের উপদেশাবলী উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ থেকেই সূরার লুকমান নামকরণ করা হয়েছে।
শানে নুযুলঃ
সুরাটি মাক্কী
সূরার আলোচনা ও বিষয়াদি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে মনে হয়, যখন ইসলামী দাওয়াতকে দমন ও প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে বিরোধীদের তরফ হইতে অত্যাচার ও নিপীড়ন শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু বিরুদ্ধতার তুফান তখনো পূর্ণমাত্রায় তীব্র ও কঠিন হয়ে উঠেনি। তখনই এ সূরাটি নাযিল হয়। ১৪-১৫ আয়াতে বিষয়টির আভাস পাওয়া যায়। সেখানে ইসলামে নবদীক্ষিত যুবকদেরকে বলা হয়েছে, আল্লাহর পরে পিতামাতার অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা যদি ইসলামে দীক্ষিত হতে বাধা দেয় এবং শিরক করতে বলে তাহলে তাদের কথা কখনোই মেনে নেবে না। সূরা আনকাবুতেও একই কথা বলা হয়েছে এ থেকে জানা যায়, সূরা দুটি একই সময়ে নাযিল হয়েছে।
*উভয় সুরার বর্ণনা রীতি ও বিষয়বস্তুর কথা চিন্তা করলে অনুমান করা যায়, সুরা লোকমান প্রথমে নাযিল হয়। কারণ এতে তীব্র আকারের বিরোধীতার চি‎হ্ন পাওয়া যায় না। বিপরীত পক্ষে সূরা আনকাবুত পড়লে মনে হবে তার নাযিলের সময় মুসলমানদের ওপর কঠোর জুলুম নিপীড়ন চলছিল।
সুতরাং বলা যায়, সূরা লোকমান রাসূল (সঃ) এর মাক্কী জীবনের দ্বিতীয় স্তরে নাযিল হয়।

*আলোচ্য বিষয়ঃ

১. শিরক অর্থহীন, অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন ব্যাপার। তাওহীদ একমাত্র সত্য ও যুক্তিসম্মত আদর্শ।
২. বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণ ও অনুসরণ পরিত্যাগ করে মুহাম্মদ (সঃ) এর আদর্শকে উন্মুক্ত মনে চিন্তা বিবেচনা করে তা গ্রহণের দাওয়াত দেয়া হয়েছে।
৩. হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর দাওয়াত কোন নতুন আওয়াজ নয়, পূর্বের জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরাও এ কথাই বলত-যেমন হযরত লোকমান।
৪. আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা, সূক্ষ্মদর্শী ও সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।
৫. নামায কায়েম, ইসলামী আন্দোলন মুমিনের বৈশিষ্ট্য বিপদে মুসিবতে ধৈর্য্যধারণ করা বড়ো সাহসিকতাপূর্ণ কাজ।
৬. অহংকার।
৭. মধ্যপন্থা অবলম্বন।
হযরত লোকমান এর পরিচয় :-

*লোকমান হাকীম আরব সমাজে একজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী হিসেবে বহুল পরিচিত ব্যক্তি। ইমরাউল কায়েস, লবীদ আশা, তারাফাহ প্রমুখ জাহেলী যুগের কবিগণ তাদের কাব্যে লুকমানের নাম উল্লেখ করেছেন। আরবের কোন কোন লোকের কাছে “সহীফা লুকমান” নামক তাঁর জ্ঞানগর্ভ উক্তির একটি সংকলন পাওয়া যেত।
*ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে লুকমানের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে অনেক মতভেদ রয়েছে। জাহেলী যুগে কোন লিখিত ইতিহাসের অস্তিত্ব ছিলনা। মুখে মুখে চলে আসা তথ্যই ছিল ইতিহাস।
*ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহের বর্ণনানুযায়ী লোকমান হযরত আইয়্যুব (আঃ) এর ভাগ্নে ছিলেন।
*তাফসীর দুররে মনসুরে হযরত ইবনে আব্বাসের (রাঃ) বর্ণনানুযায়ী লোকমান একজন আবিসিনীয় হাবশী গোলাম। হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) ইকরিমাহ ও খালেদুর রাবে-ঈ ও একই কথা বলেন। হযরত যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী (রাঃ) বলেন- তিনি ছিলেন নুবার অধিবাসী। সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব বলেন, তিনি মিসরের কালো লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনটি বক্তব্য প্রায় কাছাকাছি। আরবের লোকেরা সেকালে কালো লোকদেরকে প্রায়ই হাবশী বলত। আর নুবা হচ্ছে মিসরের দক্ষিণে ও সুদানের উত্তরে অবস্থিত এলাকা। লুকমান হাকীম ও লুকমান ইবনে আদ দু’জন আলাদা ব্যক্তি।
*হযরত যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, লুকমান চ্যাপটা নাকবিশিষ্ট, বেঁটে আকারের আবিসিনীয় ক্রীত দাস ছিলেন। মুজাহিদ (রঃ) বলেন “তিনি ফাটা পা ও পুরো ঠোঁটবিশিষ্ট আবিসিনীয় ক্রীতদাস ছিলেন। - ইবনে কাসীর।
হযরত লোকমান কোন নবী ছিলেন না, ওলী প্রজ্ঞাবান ও বিশিষ্ট মনীষি ছিলেন। - ইবনে কাসীর, ইমাম রাগবী।
কেবল ইকরিমা (রাঃ) মণিষী থেকে বর্ণিত যে তিনি নবী ছিলেন। কিন্তু এটি সনদের দিক থেকে দুর্বল।
ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন, হযরত কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত- আল্লাহ পাক হযরত লুকমানকে নবুওত ও হেকমত (প্রজ্ঞা) দু’য়ের মধ্যে যে কোন একটি গ্রহনের সুযোগ দেন। তিনি হিকমত গ্রহণ করেন।
কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে- “যদি আমার প্রতি এটা (নবুয়ত) গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়ে থাক, তবে তা শিরোধার্য, অন্যথায় আমাকে ক্ষমা কর।
কুরতুবীতে আছে, ‘মহাত্মা লোকমান হযরত দাউদ (আঃ) এর আবির্ভাবের পূর্বে মাসআলাসমূহ সম্পর্কে ফতোয়া দিতেন।
এক প্রশ্নোত্তরে তিনি মর্যাদা লাভের কারণ বলেন, ১. সর্বদা সত্য বলা ২. অপ্রয়োজনীয় কথা পরিহার করা।

হযরত লোকমানের উপদেশসমূহ
১,আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করা।

২. পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার ।
৩. নামাজ কায়েম করা।
৪. সৎ কাজের আদেশ-অসৎ কাজের নিষেধ।
৫. ধৈর্য্য ধারণ (সবর)।
৬. সামাজিক শিষ্টাচার (অহংকার না করা)।
৭. মধ্য পন্থা অবলম্বন।
৮. কণ্ঠস্বর নিচু করা।
ক.আল্লাহর সাথে শরীক না করাঃ
শিরক শব্দের অর্থ অংশীদার। মানুষ পৃথিবীতে কোন কাজে তিন কারণে অংশীদারীত্ব করে।
ক. পুঁজির অভাব খ. আংশিক পুঁজির অভাব, গ. সংশ্লিষ্ট কাজে জ্ঞানের অভাব।
যেহেতু আল্লাহ উপরোক্ত দুর্বলতামুক্ত; তাই আল্লাহর সাথে শরীক করা চরম দৃষ্টতার শামিল এবং চরম বোকামী।
শিরক মহাযুলুম, কারণ এর দ্বারা কোন ব্যক্তি এমন এক জিনিসকে/বস্তুকে সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও নেয়ামতদাতা মহান আল্লাহর সামনে দাঁড় করায়, যার এসব ব্যাপারে একবিন্দু ক্ষমতা নেই, আল্লাহর হক হল- মানুষ শুধু তাঁরই ইবাদত করবে।
অর্থঃ আমি জ্বিন ও মানব জাতিকে আমার ইবাদত ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।- আয যারিয়াহ ৫৬
* শিরক দুই প্রকারঃ
০১. আকীদাগত শিরক
০২. লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করা।

আকীদাগত শিরক
কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা এবং তার ইবাদত করা। গাছ, পাথর, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, ফিরিশতা, নবী, ওলী ইত্যাদি যাই হোক না কেন, তাকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা ও তার ইবাদত করা শিরক।
লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সৎ কাজ করা।
রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ তোমরা ছোট শিরক থেকে দূরে থাক। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন ছোট শিরক কি? তিনি বললেন, রিয়া অর্থাৎ লোক দেখিয়ে সৎকাজ করা। যেদিন আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে কর্মফল দেবেন তাদেরকে বলবেন, যাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে তোমরা নেক আমল করতে, তাদের কাছে চলে যাও। দেখ, তারা তোমাদেরকে কোন প্রতিদান দেয় কিনা।” (আহমাদ, বায়হাকী, তাবরানী)
হযরত ফযীল বিন ইযায বলেন, লোকের ভয়ে খারাপ কাজ ত্যাগ করা রিয়া, আর মানুষকে খুশী করার জন্য ভালো কাজ করা শিরক, ইখলাস হচ্ছে এ উভয় রোগ থেকে মুক্ত থাকার নাম।
* শিরকের গুনাহ ক্ষমার অযোগ্যঃ
অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়।  সূরা আন-নিসাঃ ১১৬
“সত্যের আহবান একমাত্র তাঁরই এবং তাঁকে ছাড়া যাদেরকে ডাকে তারা তাদের কোন কাজে আসে না ওদের দৃষ্টান্ত সেরূপ, যেমন কেউ পানির দিকে দু’হাত প্রসারিত করে যাতে পানি তার মুখে পৌঁছে যায়, অথচ পানি কোন সময় পৌঁছবেনা। কাফেরদের যত আহবান সবই পথভ্রষ্টতা। সূরা রাদ ১৪ আয়াতঃ
অর্থাৎ, আল্লাহর সাথে যাদের শরীক করা হয় তাদের কোন ক্ষমতা নেই, কাজে অসার। এটা পথভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
“জিজ্ঞেস করুন, নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের পালনকর্তা কে? বলে দিনঃ আল্লাহ, তবে কি তোমরা আল্লাহ ব্যতীত এমন অভিভাবক স্থির করেছ, যারা নিজেদের ভাল মন্দেরও মালিক নয়। বলুনঃ অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হয়? অথবা কোথাও কি আঁধার ও আলো সমান হয়? তবে কি তারা আল্লাহর জন্য এমন অংশীদার স্থির করেছে যে, তারা কিছু সৃষ্টি করেছে যেমন সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ? অতঃপর তাদের সৃষ্টি এরূপ বিভ্রান্তি ঘটিয়েছে? বলুন, আল্লাহই প্রত্যেক বস্তুর স্রষ্টা এবং তিনি একক, পরাক্রমশালী”। সূরা রাদের ১৬ নং আয়াতঃ
যেসব লোকেরা আল্লাহ তায়ালার বদলে অন্যকে (নিজেদের) অভিভাবক/সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে একটি মাকড়সার মতো তারা ঘর বানায় আর সব ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো অধিক দুর্বল কতো ভালো হতো তারা যদি এ সত্যটুকু বুঝতে পারতো। সূরা আন কাবুতের ৪১
তারা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে থেকে আল্লাহর অংশ স্থির করেছে। বাস্তবিক মানুষ স্পষ্ট অকৃতজ্ঞ। সুরা যুখরুখ-১৫
যদি তুমি আল্লাহ তায়ালার সাথে (অন্যদের) শরীক কর তাহলে অবশ্যই (সব) আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থদের দলে শামিল হয়ে যাবে। সূরা যুমার-৬৫
খ. পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহারঃ
পিতা মাতার সাথে আচার আচরণ, ব্যবহার ও আনুগত্যের দুটি অবস্থা-
* স্বাভাবিক অবস্থা ।
* অনৈসলামিক ক্ষেত্রে

*স্বাভাবিক অবস্থা
এ অবস্থায় মাতাপিতার কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও তাদেরকে মান্য করা ফরয।
এখানে মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য পালন এবং তাঁদের কৃতজ্ঞতা স্বীকারের নির্দেশ প্রমাণ করা হয়েছে, তখন এর হেকমত ও অন্তনির্হিত রহস্য বর্ণনা করেছেন যে, তার মা তার ধরাধামে তার আবির্ভাব ও অস্তিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার ও অবর্ননীয় দুঃখ কষ্ট বরদাশত করেছেন। নয় মাসকাল উদরে ধারণ করে তার রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন এবং এ কারণে ক্রমবর্ধমান দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও ২ বছর পর্যন্ত স্তন্য দানের কঠিন ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। দিনে রাতে মাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। আর সন্তান লালন-পালনে মাকেই যেহেতু অধিক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়, সেজন্য শরীয়তে মায়ের স্থান ও মর্যাদা অধিকার বেশী রাখা হয়েছে
(হে মুহাম্মদ) তুমি বলো, এসো আমিই (বরং) তোমাদের বলে দেই তোমাদের মালিক কোন্ কোন্ জিনিস তোমাদের জন্য হারাম করেছেন, তোমরা তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করবেনা, পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করবে------সূরা আনআম- ১৫১।
“তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারো ইবাদত করো না এবং (তোমাদের) পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। তাদের একজন কিংবা উভয়ই যদি (তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদের সাথে বিরক্তিসূচক কোন কিছু বলো না এবং কখনো তাদের গালিগালাজ করো না। তাদের সাথে সম্মানজনক, ভদ্রজনোচিত কথা বলবে“ সূরা বনি ইসরাঈল ২৩,-২৪
অনুকম্পায় ওদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বল, হে (আমার) মালিক, ওদের প্রতি (ঠিক সেভাবেই) তুমি দয়া কর যেমনি করে শৈশবে ওরা আমাকে লালন করেছিল।
“আমি মানুষকে আদেশ দিয়েছি, সে যেন নিজের পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করে, (কেননা) তার মা তাকে অত্যন্ত কষ্ট করে পেটে ধারণ করেছে, অতি কষ্টের সাথে তাকে জন্ম দিয়েছে (এবং) এইভাবে তার গর্ভধারণকালীন সময় ও (জন্মের পর) তাকে দুধ পান করানোর (দীর্ঘ) তিরিশটি মাস সময় অতপর সে (যৌবনের) পরিণত বয়সের দ্বারে এসে হাজির হয় এবং (একদিন) সে চল্লিশ বছরে এসে উপনীত হয়, তখন সে বলে, হে আমার মালিক, এবার তুমি আমাকে সামর্থ দাও, তুমি আমার ওপর (শুরু থেকে) যে সব অনুগ্রহ করে এসেছো এবং আমার পিতামাতার উপর যে অনুগ্রহ তুমি করেছ, আমি যেন এর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারি----।সূরা আল আহকাফ- ১৫
* শিশুকে ২১/২ বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানো যেতে পারে।
* গর্ভধারণের সময়কাল- সর্বনিন্ম ছয় (৬) মাস।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন-তিনটি আয়াত তিনটি জিনিসের সাথে যুক্ত হয়ে নাযিল হয়েছে। এর একটি ব্যতীত অন্যটি কবুল হয়না।
১. প্রথমটিতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর। যে ব্যক্তি আল্লাহকে মানবে ও রাসূলকে মানবেনা, তার আল্লাহকে মানা কবুল হবে না।
২. দ্বিতীয়টিতে আল্লাহ বলেনঃ
“তোমার নামায কায়েম কর ও যাকাত দাও।” যে ব্যক্তি নামায পড়বে ও যাকাত দেবে না তার নামায কবুল হবে না।
৩. তৃতীয়টিতে আল্লাহ বলেনঃ “তুমি আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং তোমার মাতাপিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।” যে ব্যক্তি মাতাপিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হবে না, তার আল্লাহর কৃতজ্ঞতা অর্থহীন ও অগ্রহণযোগ্য।
এজন্যই রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘পিতা মাতার সন্তোষে আল্লাহর সন্তোষ নিহিত এবং পিতামাতার অসন্তোষে আল্লাহর অসন্তোষ নিহিত।” তিরমিযী.
পিতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা-তিরমিযী
রাসূল (সাঃ) বলেন,সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ কী, তা কি আমি তোমাদেরকে জানাবো? তা হচ্ছে আল্লাহর সাথে শিরক করা ও পিতামাতার সাথে অসদাচারণ।”
* অনৈসলামিক ক্ষেত্রে আনুগত্য না করাঃ
অবৈধ ও গোনাহের কাজে পিতামাতার আনুগত্য জায়েয নয়।
সৃষ্টিকর্তার নাফরমানীর কাজে কোন সৃষ্ট জীবের আনুগত্য জায়েয নয়। (আল হাদীস)
“হে ঈমানদারগণ! তোমার স্বীয় পিতা ও ভাইদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না। যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালবাসে। আর তোমাদের যারা তাদেরকে অভিভাবকরূপ গ্রহণ করে তারা সীমালংঘনকারী।” (সুরা আন কাবুত- ৮ নং আয়াত)।
এ দুটি আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, পিতা মাতার আনুগত্য অপরিহার্য, তবে আল্লাহ রাসূলের (সাঃ) উপরে নয়। যখন এ দু’য়ের দ্বন্ধ দেখা দিবে তখন পরেরটিই অগ্রগণ্য হবে।
ইসলামের অনন্য নীতি
শুধুমাত্র ইসলাম বিরোধী বক্তব্যের ক্ষেত্রে মাতাপিতার আনুগত্য করা যাবে না। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের অন্য সকল আচরণে তাদের মনোকষ্ট দেয়া যাবে না। সুন্দর ব্যবহার দ্বারা তাদেরকে জয় করতে হবে।
* পিতা মাতার সেবা যত্ন ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাঁদের মুসলমান হওয়া জরুরী নয়। হযরত আম্মার (রাঃ) এর মা মুশরিকা ছিলেন। তিনি নবীকে (সঃ) এর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে রসূল (সঃ) বললেন, “তোমার জননীকে আদর আপ্যায়ন কর।”
* কোন কাজ ফরজে কেফায়ার স্তরে থাকলে সন্তানের জন্য পিতামাতার অনুমতি ব্যতিরেকে তা করা জায়েজ নয়।
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি এসে রাসূল (সাঃ) এর সাথে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইল। রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন, তোমার পিতামাতা কি বেঁচে আছেন? সে বললো  জ্বি। রাসূল (সাঃ) বললেন “তাহলে তাদেরকে নিয়েই তুমি জিহাদ কর।” অর্থাৎ তাদের সেবাই তোমার জন্য জিহাদ।- বুখারী, মুসলিম
মাতা-পিতার মৃত্যুর পরঃ
মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার এই যে তাদের মৃত্যুর পর তাদের বন্ধুদের সাথেও সদ্ব্যবহার করতে হবে। -বুখারী, (আবদুল্লাহ ইবনে উমার)
এক আনসারের প্রশ্নোত্তরে রসূল (সঃ) বলেন
“হ্যাঁ তাদের জন্য দোয়া, ই্স্তিগফার করা, তাঁরা কারো সাথে কোন অঙ্গীকার করে থাকলে তা পূরণ করা তাদের এমন আত্মীয়তা বজায় রাখা যাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক তাদেরই মাধ্যম।”
রসূল (সঃ) বিবি খাদীজার ওফাতের পর তাঁর বান্ধবীদেরকে উপঢৌকন দিতেন।
গ. নামাজ কায়েম করাঃ
ঈমানের পর ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ সালাত। সালাত এর আভিধানিক অর্থ কারো দিকে মুখ করা, অগ্রসর হওয়া মোতাওজ্জা হওয়া, দোয়া করা এবং নিকটবর্তী হওয়া। কুরআনের পরিভাষায় সালাতের অর্থ হলো আল্লাহর দিকে মনোযোগ দেয়া তাঁর দিকে অগ্রসর হওয়া, তার কাছেই চাওয়া এবং তাঁর একেবারে নিকটবর্তী হওয়া।
(১) সালাতের নির্দেশঃ
“হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে আছেন”(বাক্বারা-১৫৩)।
“আর সালাত কায়েম কর, যাকাত দান কর/ আদায় কর যারা আমার সামনে অবনত তাদের সাথে মিলে তোমরাও আমার আনুগত্য স্বীকার কর”(বাকারা -৪৩)।
“তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও। (যাবতীয় হক আদায় করে) সালাত প্রতিষ্ঠা করা (অবশ্যই একটা) কঠিন কাজ, কিন্তু যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের কথা আলাদা” (বাক্বারা- ৪৫)।
“(হে নবী) আমার যেসব বান্দাহ ঈমান এনেছে তুমি তাদের বলো, তারা যেন নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি এ থেকে যেন (আমারই পথে) ব্যয় করে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে, সে দিনটি আসার আগে, যেদিন (মুক্তির জন্য) কোনো রকম বেচাকেনা চলবে নাÑ না (তজ্জন্য কারো) কোনো প্রকার (বন্ধুত্ব) কাজে লাগবে”(ইবরাহীম- ৩১)।
তুমি তোমার মালিকের প্রশংসা দ্বারা তার পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং তুমিও সেজদাকারীদের দলে শামিল হয়ে যাও।
তোমার (নিশ্চিত) মৃত্য আসা পর্যন্ত তুমি তোমার মালিকের ইবাদত করতে থাকো (সূরা হিজর- ৯৮-৯৯)।
“আমিই হচ্ছি আল্লাহ, আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন মাবুদ নেই, অতএব তুমি শুধু আমারই এবাদত করো এবং আমার স্মরণের জন্য সালাত প্রতিষ্ঠা কর”(সূরা ত্বোয়াহা- ১৪)।
(২) সালাতের আহবানঃ

(হে নবী,) তোমার পরিবার পরিজনকে সালাতের আদেশ দাও এবং নিজেও তার উপর অবিচল থেকো, আমি তো তোমার কাছে কোনোরকম জীবনোপকরণ চাইনা আমিই তো তোমাকে রিযিক দান করেছি, আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করার জন্যই রয়েছে উত্তম পরিণাম (ত্বাহা- ১৩২)।
এ আয়াত থেকে নিজে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, পরিবারের লোকদেরও আমল করাতে হবে এবং আন্দোলনের গুরুত্ব বুঝাতে হবে এবং আদেশ করতে হবে। অনেকটা নিজের ঘর সামলানোর মত। তা না হলে নিজেই এক সময় অলসতার শিকার হতে হবে।
(৩) সালাতের সময়ঃ

আল্লাহ বলেন,“অতএব (হে নবী) এরা যা কিছুই বলে তুমি তার উপর ধৈর্য্যধারণ কর, তুমি বরং তোমার মালিকের প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর সূর্যোদয়ের আগে এবং তা অস্ত যাওয়ার আগে। রাতের বেলায় ও দিনের দু’প্রান্তেও তুমি আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা কর, তাহলে (কেয়ামতের দিন) তুমি সন্তুষ্ট হতে পারবে” (ত্বাহা- ১৩০)।
(৪) সালাতের আদায় পদ্ধতিঃ
আল্লাহ বলেন-“তোমরা সালাত সমূহের উপর (গভীরভাবে) যত্নবান হও, মধ্যবর্তী সালাতসহ (সব কয়টি সালাতেরই হেফাযত করো)। আর আল্লাহর সামনে একান্ত অবনত মনে আদবের সাথে দাঁড়াও(বাক্বারা- ২৩৮)।
মধ্যবর্তী সালাত বলতে সালাতুল আসবুরকে বুঝানো হয়েছে। কারণ অনেক লোকেরই এ সময় ব্যস্ততা থাকে।
“আপনি বলে দিন আমার প্রতিপালক সুবিচারের ন্যয় ইসলামের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তোমরা প্রত্যেক সিজদার সময়/ ইবাদতের সময় স্বীয় মুখমন্ডল সোজা রাখ এবং তাঁকে আনুগত্যশীল হয়ে ডাক। তোমাদেরকে প্রথমে যেমন সৃষ্টি করেছেন। পুনর্বারও সৃজিত হবে”।
অর্থাৎ সালাতের সময় মুখন্ডল সোজা কিবলার দিকে রাখতে যত্নবান হও। ব্যাপকভাবে প্রত্যেক কথায় কাজে স্বীয় আমলকে প্রতিপালকের নির্দেশের অনুসারী রাখ এবং সতর্ক থাক যেন এদিক ওদিক না হয়।(আরাফ- ২৯)
“যারা নিজেদের সালাত সমূহের ব্যাপারে (সমধিক) যত্নবান হয়/ সালাতসমূহের হিফাজত করে”(মুমিনুন- ১-২)।

(৫)সালাতের উপকারিতা
সালাতের উপকারিতা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গায়ই বিদ্যমান
হে নবী, যে কিতাব তোমার উপর নাযিল করা হয়েছে তা তুমি তেলাওয়াত করতে থাক। তুমি সালাত প্রতিষ্ঠা কর, নিঃসন্দেহে সালাত (মানুষকে) অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে, আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করা অবশ্যই একটি মহান কাজ। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তায়ালা তা সম্যক অবগত আছেন” (সূরা আন-কাবুত- ৪৫)।

অশ্লীল ও মন্দ শব্দের অর্থ এমন সুস্পষ্ট মন্দ কাজ, যাকে মুমিন ও কাফের নির্বিশেষে প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই মন্দ মনে করে; যেমন, ব্যভিচার, অন্যায় হত্যা, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি।
অশ্লীল ও মন্দ শব্দের অর্থ এমন কথা ও কাজকে বলা হয়, যার হারাম ও অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে শরীয়ত বিশারদগণ একমত।
মূলত এ শব্দদ্বয়ের মধ্যে যাবতীয় অপরাধ এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গোনাহ দাখিল হয়ে গেছে। যেগুলো স্বয়ং নিঃসন্দেহরূপে মন্দ এবং সৎকর্মের পথে সর্ববৃহৎ বাধা। যে ব্যক্তি সালাত কায়েম করে সে গোনাহ থেকে মুক্ত থাকে।
# কায়েম - সোজা খাড়া করা, কোন একদিকে ঝুঁকে না থাকে, রাসূল (সা.) যেভাবে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য রীতিনীতি পালন সহকারে সালাত আদায় করেছেন এবং সারাজীবন মৌখিক শিক্ষাও দান করেছেন, ঠিক সেভাবে আদায় করা, যে ব্যক্তি এভাবে সালাত আদায় করবে, সে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনা আপনি সৎকর্মের তাওফিক প্রাপ্ত হবে এবং যাবতীয় গুনাহ থেকে বাঁচার তাওফিকও। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সালাত আদায় করা স্বত্ত্বেও গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে না, বুঝতে হবে, তার সালাতে ত্রুটি বিদ্যমান।
*(রাসূল (সঃ) কে ইন্না সালাত-এর অর্থ জিজ্ঞেস করা হলে) তিনি বলেন,
*“যে ব্যক্তিকে তার সালাত অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে না, তার সালাত কিছুই নয়।” -আল হাদীস
* হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সঃ) বলেন। যে ব্যক্তি তার সালাতের আনুগত্য করে না, তার সালাত কিছুই নয়। বলাবাহুল্য, অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকাই সালাতের আনুগত্য।
সালাতের যত গুণাবলী, ফলাফল লাভ ও বরকত হাকীকতের কথা কোরআন ও হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, সবই “ইক্বামাতুস সালাহ’র সাথে সম্পর্ক যুক্ত।
তাই কোন সালাত আদায়কারী যদি গর্হিত কাজ হতে বিরত না থাকতে পারে তবে বুঝতে হবে ঐ ব্যক্তি সালাত কায়েম/প্রতিষ্ঠা করেনি।
এছাড়া সালাত আদায়কারীকে দুনিয়াতেও পুরস্কৃত করা হবে। আখেরাতে ৫টি পুরস্কার দেয়া হবে।
সালাত আমাদেরকে শিক্ষা দেয়
১. নিয়মানুবর্তিতা
২. বিনয় ও নম্রতা (যদি সালাত সেভাবে আদায় করা হয়)
৩. নেতার আনুগত্য (জামাআতে সালাত)
৪. সময়ানুবর্তিতা
৫. শৃংখলা
ঘ. সৎ কাজের আদেশ-অসৎ কাজের নিষেধঃ
এ উপদেশটি মূলত “চরিত্র সংশোধন”-এর জন্য অপরিহার্য।
ইসলামে ব্যক্তির সাথে সাথে সমষ্টির সংশোধন এ জীবন-ব্যবস্থার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অংগ। তাই সালাতের সাথে সাথেই এ উপদেশটি দেয়া হয়েছে।
এর দুটি দিক-
১. নিজের পরিশুদ্ধি।
২. গোটা মানবকুলের পরিশুদ্ধি
আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম। (আলে ইমরান-১০৪)
ঙ. ধৈর্য্য ধারণ (সবর)
“তোমার উপর কোন বিপদ মুসিবত এসে পড়লে ধৈর্য্যধারণ কর।
এ আয়াতাংশে সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, সৎকাজের হুকুম ও অসৎ কাজে নিষেধ করার দায়িত্ব যে ব্যক্তিই পালন করবে তাকে অনিবার্যভাবে বিপদ-মুসিবতের মুখোমুখি হতে হবে। ইতিহাস ও একথাই বলে যে, এ দায়িত্ব যে-ই কাঁধে নিয়ে মাঠে নেমেছে তার পেছনে দুনিয়া কোমর বেঁধে লেগেছে এবং সব ধরনের দুঃখ কষ্ট, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, উপহাস, তিরস্কার, নির্যাতন, ঠাট্টা ও তার উপর নেমে এসেছে। সেজন্য বলা হচ্ছে এ কাজে যে বিপদ মুসিবত আসবে তাতে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে।
“এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব। কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।” (বাক্বারা- ১৫৫)
যখনি তাদের সামনে (কোনো) পরীক্ষা এসে হাজির হয় তখনি তারা বলে, আমরা তো আল্লাহর জন্যই, আমাদের তো (একদিন) আল্লাহ্র কাছেই ফিরে যেতে হবে। (বাক্বারা- ১৫৬)
হে ঈমানদারগণ। তোমরা ধৈর্য্য ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করো। (বাক্বারা- ১৫৩)
এরা ধৈর্য্যশীল, সত্যাশ্রয়ী, অনুগত এবং সৎপথে ব্যয়কারী, এবং শেষরাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারী। (আলে ইমরান- ১৭)
তুমি ধৈর্য্যধারণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা নেককারদের পাওনাকে বিনষ্ট করেন না। (সূরা হুদ- ১১৫)
“তোমরা আল্লাহ তায়লা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, নিজেদের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ করোনা, অন্যথায় তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তি খতম হয়ে যাবে। (তোমরা) ধৈর্য্য ধারণ কর। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন”। (আল আনফাল ৪৬)
মানুষের যে কোন দুঃখ কষ্ট, সংকট ও প্রয়োজনের নিশ্চিত প্রতিকার সবর, সালাত।
*সবর এর তাৎপর্য্য*
‘সবর’ শব্দের অর্থ সংযম অবলম্বন এবং নফস এর উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় ‘সবর এর তিনটি শাখা আছে।
১. নফসকে হারাম এবং না জায়েজ বিষয়াদি থেকে বিরত রাখা।
২. ইবাদত ও আনুগত্যে বাধ্য করা
৩. যে কোন বিপদে-সংকটে ধৈর্য্য ধারণ করা।

ধৈর্য্যের তাৎপর্য

১. তাড়াহুড়ো না করা, নিজের প্রচেষ্টার ত্বরিত ফল লাভের জন্য অস্থিও না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা।
২. তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতার রোগোক্রান্ত না হওয়া।
৩. বাধা-বিপত্তির বীরোচিত মোকাবেলা করা এবং শান্ত চিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট বরদাশত করা।
৪. দুঃখ বেদনা, ভারাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং সহিষ্ণু হওয়া ও ধৈর্য্যওে একটি অর্থ।
৫. সকল প্রকার ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা, শয়তানের উৎসাহ প্রদান ও নফসের খাহেশের বিপক্ষে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করা।
শত প্রচেষ্টার পরও বিপদাপদ চলে আসলে তাতে ধৈর্য্যধারণ করতে হবে এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা রাখা কর্তব্য।
মূলত সাবের বা ধৈর্য্যধারণকারী সে সব লোককে বলা হয়, যারা উপরোক্ত তিন প্রকারেই ‘সবর’ অবলম্বন করে।
হাশরের দিন বলা হবে “ধৈর্য্যধারণকারীরা কোথায়?” এ কথার সংগে তিন প্রকার সবরকারী দাঁড়াবে যাদের বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।রবিপদে ইন্নালিল্লাহ পড়লে সওয়াব, অর্থের প্রতি খেয়াল রাখলে অন্তরে শান্তি পাওয়া যায়।
ইসলামী আন্দোলনে সবাই একই লক্ষ্যে যোগ দিলেও সবার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য এক নয়। এক্ষেত্রে নিজ মতের বিরুদ্ধ বিষয়েও ধৈর্যধারণ এবং সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।
চ. সামাজিক শিষ্টাচার (অহংকার না করা)
মানুষ থেকে চেহারা/মুখ ফিরে রেখো না অর্থাৎ লোকদের সাথে সাক্ষাত বা কথোপকথনের সময় মুখ ফিরে রেখো না যা তাদের প্রতি উপেক্ষা ও অহংকারের নিদর্শন এবং ভদ্রতা ও সৌজন্যতার পরিপন্থি মুখতাল বলতে বুঝায় এমন ব্যক্তিকে যে নিজেকে খুব বড় মনে করে।
(ফাখুর) বলা হয় তাকে, যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অন্যের নিকট প্রকাশ করে।
“আল্লাহর যমীনে কখনোই দম্ভভরে চলো না, কেননা (যতোই অহংকার কর না কেন) তুমি কখনোই এই জমীনকে বিদীর্ণ করতে পারবে না, আর উচ্চতায়ও তুমি কখনো পর্বত সমান হতে পারবে না”। (বনি ইসরাঈল ৩৭)
“আল্লাহ তায়ালা বললেন, (শয়তানকে) তুমি এক্ষুনি এখান থেকে নেমে যাও! এখানে (বসে) অহংকার করবে, এটা তোমার পক্ষে কখনো সাজে না, যাও (এখান থেকে) বেরিয়ে যাও, তুমি অপমানিতদেরই একজন”। (সূরা আল আ’রাফ ১৩)
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ (ঝড) জানেন, এরা যা কিছু গোপন করে যা কিছু প্রকাশ করে, তিনি কখনো অহংকারীদের পছন্দ করেন না”। (আন নাহল ২৩)
“সুতরাং আজ জাহান্নামের দরজাসমূহ দিয়ে তোমরা প্রবেশ কর। সেখানে তোমরা চিরদিন থাকবে, অহংকারীদের আবাসস্থল কতো নিকৃষ্ট”। (আন নাহল ২৯)
* অহংকার আনুগত্যের পথে অন্তরায়।
ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যার অন্তরে অনু পরিমাণও অহংকার আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি বলল, মানুষ চায় যে, তার পরিধেয় বস্ত্র সুন্দর হোক, তার জুতা জোড়া সুন্দর হোক তিনি বললেন, আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা হচ্ছে অহংকার। (মুসলিম থেকে মিশকাত)
# পার্থিব আরাম-আয়েশ ও ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে আল্লাহর অধিকার ও মানুষের অধিকার পদদলিত করার নাম অহংকার
ছ. মধ্য পন্থা অবলম্বনঃ
১৯ নং আয়াতের আরেক অর্থ এমন হয় “তোমার চলনে ভারসাম্য আন।”
“এভাবেই আমি তোমাদের এক মধ্যমপন্থী মানব দলে পরিণত করেছি, যেন তোমরা দুনিয়ার অন্যান্য সম্প্রদায়ের নিকট (হেদায়াতের) স্বাক্ষী হয়ে থাকতে পার (এবং একইভাবে) রাসূলও তোমাদের জন্য সাক্ষী হয়ে থাকতে পারে”।-(বাক্বারা ১৪৩)
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সঃ) বলেছেন, তিনটি জিনিস মুক্তিদানকারী। জিনিসগুলো হচ্ছে-

১) প্রকাশ্যে ও গোপনে খোদা ভীতি অবলম্বন করা। (২) সন্তোষ ও ক্রোধ উভয় অবস্থায় সত্য কথা বলা। (৩) প্রাচুর্য ও দারিদ্র উভয় অবস্থায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা।
# দ্রুতগতিতে চলাফেরা করলে (ক) নিজের ধপপরফবহঃ হতে পারে। (খ) অন্যের বিপদ হতে পারে।
# ধীরগতিতে চলা ৩ ধরনের ভাব প্রকাশ
১. অহংকারবশে হারাম
২. স্ত্রী লোক (লজ্জা সংকোচ) (পুরুষদের জন্য নাজায়েজ)
৩. অসুস্থতা
সুস্থ হয়েও অসুস্থতার ভান চরম অকৃতজ্ঞতা।
জ. কণ্ঠস্বর নিচু করাঃ
“তোমরা স্মরণ কর”
অর্থাৎ স্বর প্রয়োজনাতিরিক্ত উচ্চ করোনা এবং হট্টগোল করো না। হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এমনভাবে কথা বলতেন যেন উপস্থিত জনমন্ডলী অনায়াসে তা শুনতে পান, কোন প্রকার সমস্যা না হয়।
রাসূল (সঃ) তিন বস্তু সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছিলেন- ১. ঝগড়া-বিবাদ ২. অহংকার ৩. অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন কাজে আত্মনিয়োগ করা।
১. মুমিনগণ। তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের সামনে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।
২. হে ঈমানদারগণ, কখনো নিজেদের আওয়াজকে নবীর আওয়াজের ওপর উঁচু করো না এবং নিজেরা যেভাবে একে অপরের সাথে উঁচু (গলায়) আওয়াজ করো নবীর সামনে কখনো সে ধরনের উচুঁগলায় কথা বলো না, এমন যেন কখনো না হয় যে তোমাদের সব কাজ কর্ম (এই কারণেই) বরবাদ হয়ে যাবে এবং তোমরা তা জানতেও পারবে না।
৩. যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে নিজেদের গলার আওয়াজকে নিম্নগামী করে রাখে, তারা হচ্ছে সেসব মানুষ যাদের মন মগজকে আল্লাহ তায়ালা তাকওয়ার ওয়ার জন্য বাছাই করে নিয়েছেন, আর এমন ধরনের লোকদের জন্যই রয়েছে আল্লাহর ক্ষমা ও অসীম পুরস্কার।
৪. হে নবী যারা তোমাকে (সময় অসময়) তোমার কক্ষের বাইরে থেকে ডাকে, তাদের অধিকাংশই নির্বোধ লোক। (হুজুরাত ১-৪)

 শিক্ষা

১. কোন কাজে, কোন কথায় এমনকি সূক্ষ্ম কোন ব্যাপারেও আল্লাহর সাথে শরীক করা যাবে না।
ক. লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সৎকাজ শিরকেরই অন্তর্ভুক্ত
খ. শিরকের গুনাহ ক্ষমা করা হবে না।
২. পিতামাতার প্রতি সদ্বব্যহার অপরিহার্য। মাতাপিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যতীত আল্লাহর কৃতজ্ঞতা অর্থহীন ও অগ্রহণযোগ্য।
৩. অনৈসলামিক ক্ষেত্রে আনুগত্য করা যাবে না।
৪. খুশু ও খুযুর সহিত সালাত আদায় করলে মুনকার ও ফাহেশাহ কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব। এসব কিছুই “ইক্বামাতুস সালাহ” সালাত প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত।
৫. নিজের পরিশুদ্ধি ও সমাজের পরিশুদ্ধির জন্য সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ অত্যন্ত জরুরী।
৬. সকল বিপদ মুসিবত, নির্যাতন, জেল-জুলুমসহ সকল ক্ষেত্রে পরম ধৈর্য্যরে পরিচয় দিতে হবে।
৭. অহংকার বশে উদ্ধতভাবে চলাফেরা করা যাবে না।
৮. কাউকে তুচ্ছ জ্ঞান করা যাবে না।
৯. সকল কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে।
১০. দায়িত্বশীল, অভিভাবক ও সম্মানীয় ব্যক্তির সাথে উঁচু কণ্ঠস্বরে কথা বলা যাবে না।

মহান আল্লাহ তা’য়ালা আলোচ্য দারসুল কোরআন থেকে শিহ্মানিয়ে আমাদের বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর তৈাফিক দান করুন।
আমীন ।।
Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: