সূফীবাদ

পরম সত্ত্বাকে জানার ও চেনার আকাংখা মানুষের চিরন্তন। এই চিরন্তন ইচ্ছা বা বাসনা পূরণের লক্ষে যারা এগিয়ে চলে আল্লাহর পথে, তারা আল্লাহর সত্ত্বার সন্ধানে ও তার সাথে নিবিড় সম্পর্কে মিলিত হন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এই নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে পিপাসিত সাধকগণকে সুফী এবং তাদের সাধনার পথকেই তাসাউফ বা সূফীতত্ত্ব বলা হয়।

আরবী সূফ (পশম), সফ (সারি/ পবিত্রতা) সাফা (বারান্দা) শব্দগুলি বিশেষ ভাবে সম্পর্ক যুক্ত। অধিকাংশ সুফী দার্শনিকের মতে সুফী শব্দের উৎপত্তি ‘সুফ’ শব্দ হতে, যার অর্থ পশম। পূর্বে সংসারত্যাগী সাধু সন্ন্যাসীগণ মোটা কর্কশ পশমী বস্ত্র পরিধান করতেন। এই পশমী কাপড় তাঁদের অতি সাধারণ নির্বিলাস জীবনযাপনেরই পরিচায়ক ছিল।

 

অনেকের মতে সুফী শব্দের উদ্ভব আরবী ‘সাফা’ শব্দ হতে, যার অর্থ পবিত্রতা। তাঁদের মতে যেসকল মহাত্মা সাংসারিক পাপ-পঙ্কিলতা হতে কায়মনোবাক্যে পবিত্র, তাঁরাই সুফী।

ড. রোনাল্ড এ নিকলসনের মতে পশমী পোষাক পরিচ্ছেদ পরিধানও আত্মার বিশুদ্ধতার জন্য জরুরী এবং সূফীরা তা পরতেন বিধায় তারা সুফী নামে পরিচিতি।

মোল্লা জামী বলেন : ‘‘শব্দটি (পবিত্রতা ও স্বচ্ছতা) থেকে নির্গত হয়েছে। যেহেতু তারা পূতপবিত্র ও স্বচ্ছ জীবনযাপন করতেন।’’

আবার কেউ কেউ বলেন : ‘‘সুফী শব্দটি গ্রীক সাফিয়া শব্দ থেকে উদ্ভাবিত। সাফিয়া অর্থ জ্ঞান। সুফীরা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী বলে এ নামে খ্যাত।’’

হযরত আবু আব্দুল্লাহ্‌ খাফিফ (রঃ) বলেন : ‘‘খোদা যাকে তার প্রেম দ্বারা পরিশুদ্ধ করেছেন তিনিই প্রকৃত সূফি।’’

আর তাদেরকে সূফী বলা হয় এই কারনে যে, তারা অহংকারী পোষাক তথা নিজের বড়ত্ব বিলিন করে আল্লাহর আদেশ পালনকারীর সব প্রচেস্টায় নিজেকে নিয়জিত রাখে।

আবার অনেকের মতে ‘আসহাবে সুফফা’ হতে সুফী শব্দের উৎপত্তি। হযরত রসূল করিম (সঃ)-এর একদল সাহাবা ইসলাম গ্রহণের পর মসজিদে নববীর এক পার্শ্বে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। এ সকল সাহাবাদের সাথে হযরত রসুল করিম (সঃ) আল্লাহতালার রহস্য সম্পর্কে আলোচনা করতেন যা আরবদের বড় বড় তত্ত্বজ্ঞানী ও সাধারণ সাহাবাগণ বুঝতে সক্ষম হতেন না। এ সকল সাহাবাদেরকে তিনি তাঁর চাদর বা জামা মোবারক দান করে সম্মানিত করতেন। এ চাদর বা জামাকে নাকি ‘সুফ’ বলা হতো এবং ‘সুফের’ অধিকারি ব্যক্তিকে বলা হত ‘আহলুস সুফফা’ বা চাদর পরিহিত ব্যক্তি। এ সম্মানিত সাহাবাদেরকেই সুফী মনে করা হতো। কেউ কেউ আবার কুফার জামী আবু হাসীম (রাঃ)-কে প্রথম সুফী হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। আবার কারো কারো মতে, হযরত জামির বিন জায়না (রাঃ) হচ্ছেন প্রথম সুফী।

প্রকৃত পক্ষে “সূফী” বিশেষ শ্রেনীর ছালেহিনদের নাম। এ প্রসংগে রাসূল (সঃ) হাদীস শরীফে বর্ননা করেন : “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সাথে উঠাবসা করতে চাও, সে যেন আহলে তাসাউফ পন্থিদের সাথে অবস্থান করে।”(আল-হাদিস)

এছারাও সূফী বা আউলিয়াদের সম্পর্কে রাসূল (সঃ) এরশাদ করেন : “আল্লাহ বলেন- আমার কিছু বান্দারা নফল বন্দেগীর মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হতে থাকে, ফলে আমি তাকে মুহাব্বত করতে থাকি। যখন সে আমার মুহুব্বতের পাত্র হয়ে যায়, তখন আমি তার কান হয়ে যাই- যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে। আমি তার হাত হয়ে যাই- যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে, যখন সে আমার কাছে কিছু চায়, আমি অবশ্যই তাকে সে জিনিস দেই।” (হাদীসে-কুদছী, মিশকাত, বুখারী শরীফ)

সংক্ষিপ্ত ভাবে বলতে- সূফী শব্দের অর্থ- আল্লাহ্‌র সাধক, যারা এমন এক জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ঘটায় এবং সর্ব শক্তিমান আল্লাহর ণৈকট্য ও ভালবাসা লাভ করে উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হয়ে আল্লাহর প্রতিনিধি মর্যাদায় পৌছায়। এই বিশেষ জ্ঞানই হল ইলমে মারফত বা তাসাউফ। আর সুফীগণের তাসাউফ চর্চাকেই বলা সুফীবাদ।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: