আল্লাহর ঘর কাবা শরিফ। একে বেষ্টন করে আছে মসজিদুল হারাম। সবার ঊর্ধ্বে কাবার মর্যাদা। সারা দুনিয়ার মুসলমান যে যেখানেই থাকুক, কাবার সাথে তার প্রাণের সম্পর্ক। মক্কার কাবা আর হৃদয়কাবা একাকার হয়ে আছে প্রতিটি মুমিনের মানসপটে। মহান স্রষ্টার সাথে মানুষের সংযোগ কেন্দ্র হচ্ছে পবিত্র কাবা।
দেহ আর আত্মার যে সম্পর্ক, ইসলামের সাথে কাবার সেরূপ সম্পর্ক। জীবাত্মা ও পরমাত্মার সেতুবন্ধনই এই কাবা। সেখানে মুসলমানরা পাগল হয়ে ছুটে যান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য। কাবাঘর আল্লাহর আরশে মুআল্লাহর ছায়াতলে সোজাসুজি বায়তুল মামুরের আকৃতিতে স্থাপিত। হজরত আদম আঃ-এর প্রার্থনার পরিপ্রেক্ষিতে ফেরেস্তারা বায়তুল মামুরের এ প্রতিকৃতি দুনিয়ায় নামিয়ে আনেন। নূহ আঃ-এর বন্যার সময় কাবাঘরটি প্রায় ধ্বংস হওয়ার পর হজরত ইব্রাহিম আঃ ও ইসমাইল আঃ কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে নবী-রাসূল, নবী করিম সাঃ, সাহাবি, তাবেতাবেইনসহ তুর্কি ও সৌদি বাদশারা ওই ঘরের সংস্কার ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন।
বিশ্বের প্রতিটি মুসলমান 'কাবাতিশ শরিফাতে আল্লাহু আকবর' বলে কাবার দিকে মুখ করেই নামাজ আদায় করেন। আল্লাহর প্রেমে উতলা হয়ে দমে দমে স্মরণ করেন এক ও সর্বশক্তিমান তাঁকে। একমাত্র তাঁর চরণে আত্মসমর্পণের জন্য। মুসলমানরা হজে যান কোরবানি করেন। হজ হচ্ছে বিশেষ সময়ে বিশেষ কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে তাজিমের সাথে বায়তুল্লাহ জিয়ারত করার ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের নাম। হজ ইসলামের সর্বোত্তম ইবাদত। এতে রয়েছে ঈমানের দৃঢ়তা, নামাজের বিনম্রতা, রোজার সহিষ্ণুতা এবং জাকাতের অর্থ ব্যয়িতা। মূলত হজ হচ্ছে সাধনার সর্বশেষ পর্যায়। অপর দিকে আরবি ‘কুরব’ অর্থ নৈকট্য। শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর নৈকট্যলাভের আশায় মহান আল্লাহর নামে কোনো কিছু উৎসর্গ (হালাল পশু জবাই) করাকে কোরবানি বলে। কোরবানি বোঝাতে ‘তাজহিয়া’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ To Sacrifice to make offerings to Allah, সামর্থ্যবান প্রেমিকরা স্বশরীরে মক্কায় গিয়ে কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়াদৌড়ি, মিনায় অবস্থান, কঙ্কর নিক্ষেপ, কোরবানি করা প্রভৃতি কার্য নবী করিম সাঃ যেভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেভাবে করে থাকনে। সামর্থ্যহীন প্রেমিকরা কাবার দৃশ্য হৃদয়ে ধারণ করে সর্বক্ষণ তওয়াফ করতে থাকেন।
বায়তুল মামুরের আকৃতিতে জ্যোতির্ময় কাবাঘরকে মহান আল্লাহতায়ালা স্বয়ং করেছেন সম্মানিত, বরকতময় ও কল্যাণের আধার। বেতারযন্ত্র বা স্যাটেলাইট সংযোগ কেন্দ্রের মতো বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য কাবা শরিফ হলো আধ্যাত্মিক সংযোগ কেন্দ্র। দয়াময় স্রষ্টার এ পবিত্র কাবাগৃহে ঈমানদারদের দৃষ্টি পড়ার সাথে সাথেই অনেক পাপ মুছে যায় এবং আরাফার মাঠে অবস্থানের দ্বারা তার সব ধরনের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
যেহেতু বায়তুল মামুরের প্রতীক কাবাঘর, তাই কাবার দিকে মুখ ফেরানো অর্থ বায়তুল মামুরের দিকে মুখ ফেরানো। আর বায়তুল মামুরের দিকে মুখ ফেরানো মানেই হলো মহান আল্লাহর দিকে মুখ ফেরানো এবং আল্লাহর দিদার লাভে ধন্য হওয়া।
হজরত ইব্রাহিম আঃ ও হজরত ইসমাইল আঃ-এর মাধ্যমে এ কাবা ঘরকে আল্লাহতায়ালা পুনর্বার মহিমান্বিত করেছেন। ‘আমি ইব্রাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ দিলাম, আমার গৃহকে পবিত্র করো।’ [সূরা বাকারা, আয়াত-১২৫]। কাবায় এখন যে কালো পাথরটি রয়েছে, অনেকের মতে তা হজরত আদম আঃ-এর সময়কার কাবার পাথর খণ্ডবিশেষ। আল্লাহর ঘর পবিত্র কাবা পৃথিবীতে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে চিরকাল। ‘আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্য সম্মেলন ও নিরাপত্তার স্থান করলাম। আর তোমরা ইব্রাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা বানাও। তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।’ [সূরা বাকারা, আয়াত-১২৫]।
তাফসিরবিদ মুজাহিদ বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বায়তুল্লাহর স্থানকে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার বছর আগে সৃষ্টি করেছেন। এর ভিত্তিস্তর সপ্তম জমিনের অভ্যন্তর পর্যন্ত পৌঁছেছে। সহি নিয়তে মর্যাদাবান এ ঘরে এক রাকাত নামাজ আদায় করলে অন্য জায়গা এক লাখ রাকাত নামাজের সমান সওয়াব লেখা হয়ে যায়। তেমনি অন্য এবাদতেও এক লাখ গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।’ তাই উম্মতের দরদী নবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ কাবাঘরকে যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন করেছেন। কেয়ামত পর্যন্ত কাবাঘরের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তিনি তাঁর উম্মতদের আদেশ করেছেন ‘যে বায়তুল্লাহ শরিফে সাত চক্কর তওয়াফ করবে, মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে দু’রাকাত নামাজ পড়বে এবং জমজমের পানি পান করবে তার গোনাহ যত বেশি হোক না কেন তা মাফ করে দেয়া হবে।’ (মুসলিম শরিফ)
হজের মৌসুমে সমগ্র বিশ্ব থেকে লাখ লাখ মুসলমান কাবার উদ্দেশ্যে সমবেত হয়ে এক আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। একই সাজে সজ্জিত বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন ভাষাভাষীর অসংখ্য মুসলমানের একটাই প্রার্থনা হওয়া উচিত আমরা বিশ্বের সব মুসলমান যেন এক ব্যক্তিসদৃশ হতে পারি। তার শিরপীড়ায় গোটা বিশ্বের মুসলমানের শরীর যেন বেদনায় জর্জরিত হয়। প্রত্যেকে যেন আমরা ভেতরের পশুত্বকে কোরবানি দিতে পারি। এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে আরব-অনারব, রাজা-প্রজা, সাদা-কালো, সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে সত্যের সংগ্রামে জয়ী হতে পারি। পথভ্রষ্টতা ও গোনাহের কাজে যাতে লিপ্ত না হই।
হে প্রেমময় রাহমানুর রাহিম, আমাদের ত্যাগ ও কোরবানি কবুল করে নাও। আমরা হাজির, আমরা তোমার দরবারে হাজির। সবার মুখে, সবার মনে, আকাশে-বাতাসে একই কথা, একই ধ্বনি লাব্বাইকা, আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা...।
***************************
লেখকঃ মোশারেফ হোসেন পাটওয়ারী
উৎসঃ দৈনিক নয়াদিগন্ত,