আল্লাহ ওয়ালাদের সাথে আত্মশুদ্ধির সম্পর্ক গড়ুন

শরিয়তে তাযকিয়ায়ে নফছের গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা মানুষের অন্তর আর চিন্তা চেতনা যদি পবিত্র হয়ে যায় তাহলে গোটা সমাজ আর পরিবেশ ভাল না হওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারেনা। মানুষের অন্তরে যখন আখেরাতের ইয়াকীন আর আল্লাহর ভয় থাকেনা তখন মানুষ চুরি, ডাকাতি, মাদক সেবন, জোর জুলুম সহ বিভিন্ন রকমের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে আল্লাহর ভয় আর আখেরাতের ইয়াকীন বড় বড় গুনাহে অভ্যস্ত মানুষকে পর্যন্ত হাতে অদৃশ্য হাত কড়া আর পায়ে অদৃশ্য ডাণ্ডা বেড়ি পরিয়ে দেয়। তখন সে এভাবে শুধরে যায় যে রাতের অন্ধকারেও তার মন কোনও অপরাধের দিকে যায়না, পরের সম্পদের প্রতি তার লোভ হয়না, পাপের উপকরণ থাকা সত্ত্বেও সেদিকে তার খেয়াল যায়না। একারণে পবিত্র কোরানে তাযকিয়ায়ে নফসের ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

 

আরবে যখন নবী করিম [সঃ] এর আগমন ঘটে তখন আরব জাতি ছিল যুদ্ধবাজ, অসভ্য, অসৎ কাজে অভ্যস্ত। আল্লাহ তালার মারফতের ধারে কাছেও ছিলনা তারা। স্বভাব চরিত্র ছিল গোঁয়ার প্রকৃতির। কিন্তু নবী করিম [সঃ] এর সাহচর্যে এসে তারা এতই বদলে গেলো যে সারা দুনিয়ার জন্য হেদায়েতের আলোকবর্তিকা হয়ে গেলো। যারা অসভ্য ছিল সভ্য হয়ে গেলো। যারা অসংখ্য দেব দেবীর পূজারি ছিল তারা এক আল্লাহর এবাদত কারি হয়ে গেলো। যারা গোঁয়ার ছিল তাদের স্বভাব নরম হয়ে গেল। যারা অখ্যাত ছিল তারা গোটা দুনিয়ার জন্য ইমাম হয়ে গেল। হযরত আবু বকর [র:] ছিদ্দিক হয়ে গেলেন, ওমর [র:] ফারুক হয়ে গেলেন, ওসমান গনী [র:] জুন্নুরাইন হয়ে গেলেন, আলি [র:] শেরে খোদা হয়ে গেলেন একমাত্র রসুল করিম [সঃ] এর সাহচর্যের বদৌলতে। হযরত বেলাল [র:] আরবের বাইরের ছিলেন। গোলাম ছিলেন,‌ কেউ চিনতো না, হযরত ছালমান ফারসি [র:] ও আরবের বাইরের ছিলেন, অখ্যাত ছিলেন। কিন্তু রসুল [সঃ] এর সাহচর্যের বদৌলতে তাদের মর্যাদা এতই বৃদ্ধি পেল যে তারা মুসলমানদের সরদার হয়ে গেলেন।
রসুল করিম সঃ এর পরে সাহাবী, তাবেঈন, তবে তাবেঈন, তার পরে আওলিয়াউল্লাহ আর বুজুর্গানে দীনের সাহচর্যে এমন প্রভাব থাকে যে কঠিন থেকে কঠিন পাথর হৃদয় পর্যন্ত মোমের মত গলে যেতে পারে। অন্তরে আল্লাহর ভয় আর আখেরাতের আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে।

মানুষের মধ্যে সাধারণত অহংকার, হিংসা, দুনিয়ার লোভ-লালসা, আখেরাত সম্পর্কে উদাসীনতা, গুনাহের প্রতি আগ্রহ ইত্যাদি দোষ গুলি থাকে। এই সমস্ত দোষ গুলি শয়তানের ওয়াসওয়াসা আর কুমন্ত্রণার দ্বারা দৃদ্ধি পেতে থাকে। আল্লাহর নেক বান্দা গন রিয়াজাত আর মুজাহাদার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করেছেন তাই তারা শয়তানের এসমস্ত ধোঁকা সম্পর্কে সহজে অবগত হন বলে সহজে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাচতে পারেন। আর যারা তাদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের কাছ থেকে শয়তান আর নফসের ধোঁকা থেকে বাচার বিভিন্ন তদবির শিখেন তারাও শয়তানের ধোঁকা সম্পর্কে সহজে অবগত হন আর সহজে বাচতে পারেন। আল্লাহর নেক বান্দাদের বাতানো রাস্তায় চলার কারণে নফসের বিভিন্ন দোষ গুলি আস্তে আস্তে ত্যাগ করা সহজ হয়ে যায়।

আর বুজর্গানে দীনের সাহচর্যে এসে মানুষ নফসের দোষ ত্রুটি গুলো সহজে ত্যাগ করে তার স্থলে আল্লাহর ভয় আল্লাহর মারেফাত আখেরাতের প্রতি মনোযোগী হওয়া ইত্যাদি ভাল গুনে গুণান্বিত হতে পারে। তখন সে যেখানেই থাকেনা কেন সব সময় আল্লাহর ভয় তার অন্তরে সদা জাগ্রত থাকে। এটাকেই সুফিয়ায়ে কেরামের পরিভাষায় তাসাওউফ আর সুলুক বলে।

তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য শরিয়ত মতে চলা। শরিয়ত বাদ দিয়ে তরিকতের কোনও মূল্য নাই। বুজুর্গানে দীন মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য যেসমস্ত পন্থা অবলম্বনের কথা বলে থাকেন তা আসল উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য হল বুজুর্গানে দীনের সহযোগিতায় শরিয়ত মতে চলা, যার হুকুম কোরান হাদিসে এসেছে।
আগের তুলনায় এখন মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে। সময় সংকুচিত হয়ে আসছে। মানুষের কাছে আজকাল আত্মশুদ্ধির পেছনে ব্যয় করার মতো সময় অনেক কম । যার কারণে নিজে নিজের আত্মশুদ্ধি করা অসম্ভব নাহলেও কঠিন। তাই এমন আল্লাহ ওয়ালা মানুষদের সাথে সম্পর্ক রাখা ভাল যারা পুরোপুরি কোরান হাদিস মতে চলে। যাদের অন্তরে দুনিয়ার লোভ নাই। যাদের সংস্পর্শে আসলে আল্লাহর ভয়, আখেরাতের ধ্যান অন্তরে জাগ্রত হয়। যারা মানুষের কাছ থেকে দুনিয়াবি ফায়দা লাভ করেনা। মান সম্মান অর্থ বিত্ত কিছুই না।

আজ কাল আমরা যে পরিবেশে বাস করছি তা গুনাহ আর বিভিন্ন অপরাধে ভরা। মানুষের জীবনে পরিবেশের খুব বেশি প্রভাব পড়ে। একবার সাহাবায়ে কেরাম সহ নবী করিম সঃ কাউমে আ’দ এর বস্তি হয়ে যাওয়ার সময় হুজুর সঃ কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন, এবং সাহাবায়ে কেরামকে বস্তি তাড়াতাড়ি পার হওয়ার হুকুম দিলেন।এতে বুঝা যায় পরিবেশের প্রভাবকে হুজুর সঃ খুব গুরুত্ব দিতেন।
এমনিতেও দেখা যায় মানুষ যে রকম পরিবেশ গ্রহণ করে সেই পরিবেশ অনুযায়ী তার মন মেজাজ চিন্তা চেতনার পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই আল্লাহ ওয়ালা বুজুর্গ ব্যক্তি গনের সান্নিধ্যে এসে অনেক খারাপ কাজে অভ্যস্ত মানুষও ভাল হয়ে যেতে দেখা যায়। আর অনেকে সম্পূর্ণ ভাল হতে না পারলেও অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হয়। গুনাহ সমূহের জন্য লজ্জিত হয়। তৌবা করার সুযোগ হয়।

অনেকেই বলে থাকেন আজকাল সেই রকম আল্লাহ ওয়ালা মানুষ নাই। যাদের সান্নিধ্যে এসে মানুষ অপরাধ ছেড়ে দীনদার হতে পারে। এটা শয়তানের একটা ধোঁকা।
মনে রাখা দরকার আল্লাহ ওয়ালা দীনদার ব্যক্তি সব সময় ছিল এবং থাকবে। আল্লাহ তালা বলেন।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِين 119

হে ঈমান দারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।

এর দ্বারা বুঝা গেল সত্যবাদী নেককার লোক আল্লাহ তালা প্রত্যেক যুগে প্রেরণ করেন। নাহলে তিনি মানুষ কে সত্যবাদীদের সাথে থাকার হুকুম দিতেন না। সেই সব নেককার ব্যক্তিদেরকে খোজে বের করা আমাদের দায়িত্ব। তবে হ্যাঁ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বেলায়েত এর মধ্যেও অনেক কমজোরি এসে গেছে। একটা যোগ ছিল যখন উস্তাদ শাগরেদ উভয়ই কামেল ছিল। তখন জুনাইদ বাগদাদী আর হাসান বসরীর মত নেককার বুজুর্গকে উস্তাদ হিসেবে পাওয়া যেত। এখন তাদের মতো বুজুর্গ তালাস করা বৃথা। আজকাল আমাদের জন্য জুনাইদ বাগদাদী আর হাসান বসরী হচ্ছেন সেই সব নেককার আলেম ব্যক্তি যাদের সাহচর্যে আসলে মানুষের মনে আল্লাহর মুহাব্বাত সৃষ্টি হয়। আখেরাতের ফিকির আসে। দুনিয়ার মুহাব্বাত কম হতে থাকে। চরিত্র ভাল হয়ে যায়। যিনি কোরান হাদিস মত চলেন, নবী করিম সঃ এর সুন্নাতের পাবন্দি করেন। তাহলে বুঝে নিতে পারেন তিনি আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তি।

তাসাউফে একমাত্র আল্লাহ্‌ই হলেন সকল ইবাদতের ও সমস্ত সাধনার মুখ্য উদ্দেশ্য। আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে একমাত্র তাতেই আত্মসমর্পন ও আত্মবিলীন করে তাকে লাভ করা বা তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাই সুফী সাধনার গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য। একমাত্র আল্লাহ্‌র প্রেমে আপনাকে ফানা করে দিয়ে তাকেই আকাংখা এবং প্রেমিকের ন্যায় পরম প্রেমাস্পদকে পাওয়ার উদ্দেশ্যে কঠিন ও কঠিনতর পথ অতিক্রমের চেষ্টা।

আসাহবে সুফ্‌ফা বা সুফিদের সূফী সাধনায় গুরু ছিলেন হযরত রাসুল্লাহ (সাঃ)। তাছাড়া হযরত রাসূল্লাহ (সাঃ) কে সুফি সিলসিলার আদিগুরু বলা হয়। জীবনে বাস্তব ক্ষেত্রে সুফী সাধনার প্রয়োগ এবং কথাবার্তায় সুফি ভাবের প্রকাশ সহ যিকির, ধ্যান, মগ্নতা, গুঢ়তত্ত্ব বিষয়সমূয় রাসূল (সাঃ) জীবনে পরিলক্ষিত হয় এবং তাঁর আসহাব ও তাবেয়ীনদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। রাসূল (সাঃ) বলেন-

আসহাবে কান নজুমে বেআইহে হীস একতায়েতুম এহদেতাতুম।

অর্থ ঃ আমার সাহাবাগণ তারকা সাদৃশ্য। তোমরা এদের মধ্যস্থিত যেকোন একজনের অনুসরণ করলে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে।

এরই ধারাবাহিকতায় সুফি সাধনার পরবর্তী পর্যায়ে একে সুফি সাধনার শিক্ষকরা তাদের অনুসারীদের মধ্যে এ জ্ঞান বিতরণ করেছেন। সুফী সাধনায় তাই শিক্ষককে পীর ও মুরশিদ এবং ছাত্রকে বা অনুসারী সাধকগণকে ভক্ত বলে অভিহিত করা হয়। মুরীদ বা সুফী সাধককে এ জ্ঞান অর্জন করে পূর্ণ মানবে পরিণত হলে পীরের নিকট শরনার্পন হয়ে পীর প্রদত্ত পথে অগ্রসর হতে হয়। আল্লাহ্‌কে পাওয়ার জন্যই পীর প্রদত্ত ও প্রদর্শিত রাসূলের পথে এ পথ পরিক্রমা। মূলত: আল্লাহ্‌কে পাওয়ার জন্য এ সবই ওসিলা মাত্র। এজন্যই আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন-

ইয়া আইয়্যুহাল লাযিনা আমানুততাকুল্লাহা ওয়াবতাহূ ইলায়হিল ওসিলাতা ওয়া জাহিদু ফী সাবিলিহী লাআল্লাকুম তুফলিহুন (৫ঃ৩৫)।

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ ! আল্লাহ্‌কে ভয় কর এবং তাঁর পথে ওসিলা বা মধ্যস্থতা অন্বেষণ কর এবং আল্লাহ্‌র পথে জিহাদ করো, এ পথেই তোমরা মুক্তি পাবে।

এখানে ওসিলা বলতে পীর বা শায়েখ বা মুরশিদকে বুঝানো হয়েছে এবং জিহাদ বলতে কু-প্রভূতি বা নফসের বিরুদ্ধে জিহাদকে বুঝান হয়েছে। নিজের কু-প্রভূতি বা নফসের কুসত্ত্বাগুলোকে দূরিভূত করে পীরের প্রদত্ত ও প্রদর্শিত রাসূলের পথে এ পথ পরিক্রমা অতিক্রমের মাধ্যমেই আল্লাহ্‌র নিকটবর্তী হয়ে তার দিদার ও দর্শন লাভ করা যায়।

মুরশিদ ই হলেন সুফি সাধকের পথ প্রদর্শক। তিনি পীর বা জ্ঞানবৃদ্ধ। ইসলামী আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে পীর হলেন বাস্তব বা বাহ্যিক এবং আত্মিক বা অভ্যান্তরীণ জ্ঞান ও অনুভূতির শিক্ষক। সুতরাং মুরশিদ বা পীরের অনুসরণের মাধ্যমেই সেই পরম প্রকাশিত সুন্দর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌কে লাভ করা যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন-

ইয়া আইয়্যুহাল্লাজীনা আমানু আম্ব্রি উল্লাহা অআতী উর রাসূলা আউলিল আম্ব্রিª মিনকুম (৪ঃ৫৯)।

অর্থ ঃ তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ্‌ র এবং আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে ফয়সালার অধিকারী ।

তাই সেই পরম প্রকাশিত সুন্দর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌র দিদার লাভ করতে হলে মুরশীদের নিকট আনুগত্তের বিকল্প নেই বললেই চলে।

পরিশেষে বলতে চাই দুনিয়ার লোভ ত্যাগ করে নেককার বুজুর্গ ব্যক্তিদের সাহচর্যে থেকে নিজের চরিত্র ঠিক করে দীন মতে চললে দুনিয়া আখেরাত দু জাহানেই শান্তি পাওয়া সম্ভব। নেককার ব্যক্তিদের সান্নিধ্য ছাড়াও চরিত্র ঠিক করা যায় তবে তা খুব কঠিন।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: