ইলম তাসাউফ হলো ইসলাম ও ঈমানলব্ধ জ্ঞান। আধ্যাত্মকি জ্ঞান ছাড়া বাহ্যকি জ্ঞান অচল। সূর্য্য বা আলো না থাকল চোখের জ্যোতি দিয়ে যেমন কছিু দেখা যায় না। অনুরূপভাব, আধ্যাত্বিক জ্ঞান ছাড়া বাহ্যিক জ্ঞান জগতের কল্যাণ ও মঙ্গল সাধন অক্ষম। মাওলানা রুমী (রঃ) বলনে : “জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শুধু সংশয় ও দ্বিধা বর্ধিত করে। পক্ষান্তরে দ্বীন-ইসলাম ও ঈমানলব্ধ জ্ঞান উর্দ্ধের উর্দ্ধে পোঁছিয়ে দিতে সক্ষম হয়।’’
তাসাউফ’ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান হচ্ছে এমন একটি জ্ঞান যে জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহকে চেনা যায়, আল্লাহকে পাওয়া যায়, আত্মাকে আলোকিত করা যায়। ইসলামী শরিয়াতের দৃষ্টিকোন থেকে ইলমে তাসাওউফের গুরুত্ব অপরিসীম। তাসাওউফ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একে অস্বীকার করা যায়না। কারন তাসাওউফ ব্যাতিত মানবতার আধ্যাত্নিক উতকর্ষ সাধিত হতে পারে না। প্রবিত্র কোরআন এবং হাদীসের মাধ্যমে রসুল (সা:)এই বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন।
তাসাউফের সাধারণ অর্থ সৃষ্টিতে ভুলে শ্রষ্টার (আল্লাহ্র) স্মরণে লিপ্ত থাকা। তাসাউফের মূল কথাই হল আল্লাহ্র উপলব্ধি। সকল প্রকার কর্ম, ইবাদত পদ্ধতি ও নিয়মের মাধ্যমে আল্লাহ্র উপলব্ধি ও পরম সত্ত্বার নৈকট্য লাভকেই তাসাউফ বা সূফিদর্শনের মূল লক্ষ্য বলা হয়। সকল জ্ঞানের উর্দ্ধে সত্য জ্ঞান এবং সত্য জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহ্র উপলব্ধিকেই তাসাউফ বলা হয়।
সকল প্রকার ইবাদতেই আল্লাহ্র অনুভূতি লাভ বা শরিয়ত তরিকত, হাকিকত ও মারফতের মাধ্যমে মানব জীবনের প্রকাশ্য (যাহিরী) ও (বাতেনী) গোপন বিষয়ে বিশুদ্ধতার মাধ্যমে পরম সত্ত্বার নৈকট্য লাভই তাসাউফ। এক কথায়- আল্লাহ্ ও আল্লাহ্র রাসুলের হুকুম অদৃশ্য (বাতেনী) যা আত্মা দ্বারা পালন করা হয় তাকে তাসাউফ বলে। তাসাউফের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বিভিন্ন সূফি দরবেশ ও সুফিচিন্তাবিদগণ বিভিন্ন সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন।
তাসাওউফ শব্দ লিখতে তা-ছোয়াদ-ওয়াও এবং ফা শব্দ লাগে যার উচ্চারণ হল তাসাওউফ। তাসাউফ শব্দটি তাফাউল এর মাসদার যার মূল অক্ষর হল ছোয়াদ-ওয়াও এবং ফা এর আভীধানিক অর্থ হল, আধ্যাত্নবাদ, আধ্যাত্নিকতা। অর্থাৎ কলবের অপবিত্রতা থেকে প্রবিত্র থাকা।
দায়েরাতুল মা‘আরেফাত গ্রন্থকার আল্লামা বুসতানী (র) বলেন : ‘‘তাসাওউফ শব্দটি আছছুফু শব্দথেকে নির্গত যার অর্থ হল-পশম, লোম wool ইত্যাদি। ‘সুফ অর্থ পশম আর তাসাওউফের অর্থ পশমী বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস। অতঃপর কোরআন হাদীসের জ্ঞানের মাধ্যামে মরমীতত্ত্বের সাধনায় কাহারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ।’’
ইসলামি পরিভাষায় তাসাওউফ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধি বা তাজকিয়ায়ে নফস এর মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সাধনাকে বুঝায়।
মারূফ আল-কারখী বলেন : “তাসাউফ ঐশী সত্তার উপলব্ধি।”
কারো কারো মতে : “পরমত্মার সাথে জীবাত্মা মিল সাধন।”
আল কুরাইশী বলেন : “বাহ্য ও অন্তর্জীবনের পরিশুদ্ধিই হল তাসাউফ।”
জাকারিয়া আনসারী বলেন : “চিরন্তন ও নিখুঁত আনন্দ লাভের জন্য ব্যক্তিসত্তাকে শুদ্ধিকরণ, নৈতিক চরিত্রের উন্নতি বিধান এবং বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ জীবনকে সঠিকভাবে গড়ে তোলাই তাসাউফ।”
তাসাউফ সম্পর্কে মাওলানা মওদুদী সাহেব ‘ইসলাম পরিচিতি’ নামক বইয়ে বলেছেন : “ফিকাহর সম্পর্ক হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য কার্যকলাপের সাথে। তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই যে, আমাকে যেভাবে, যে পদ্ধতিতে কোন কাজ করার বিধান দেয়া হয়েছে, সঠিকভাবে তা করছি কিনা। যদি তা সঠিকভাবে পালন করে থাকি, তাহলে মনের অবস্থা কি ছিল তা নিয়ে ফিকাহর বলার কিছু নেই। মনের অবস্থার সাথে যার সম্পর্ক সে জিনিসটিকে বলা হয় তাসাউফ। (কুরআন শরীফে এ জিনিসটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘তাযকিয়া’ ও ‘হেকমত’। হাদীসে একে বলা হয়েছে ‘ইহসান’ এবং পরবর্তী লোকেরা একে অবিহিত করেছেন ‘তাসাউফ’ নামে।)।’’
হযরত ইমাম গায্যালী (রঃ) বলেছেন : ‘‘আল্লাহ্ ব্যতীত অপর সবকিছু থেকে হৃদয়কে পবিত্র (তাজকিয়ায়ে নফস) করে সত্য আল্লাহ্র আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্তে নিমগ্ন হওয়ার অপর নামই তাসাউফ।’’
এখানে হযরত ইমাম গায্যালী (রঃ) ইসলামের মর্ম সঠিকভাবে উপলব্ধি করে ইসলামের তথা জীবনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন দু’দিকের প্রতিই সমান গুরুত্ব আরোপ করে নৈতিকতাবোধ ও তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় গ্লানি, আবর্জনা ও অন্তরায় সমূহকে পরিত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
হযরত জুনায়েদ বোগদাদী (রঃ) বলেন : ‘‘জীবন ও মৃত্যুসহ সকল বিষয়ে আল্লাহ্র উপর পরিপূর্ণ নির্ভরতাই তাসাউফ। আপনার অহংবোধকে যতক্ষণ জীবিত রাখা যাবে ততক্ষণ পরম জাত পাককে উপলব্ধি করা যাবে না। অহং প্রবৃত্তিকে বিনাশ করে তাকে পাওয়া যাবে। সর্বদা তারই রহমত ও সাহায্য আকাংখা করা ও তাকেই ভালোবাসার নাম তাসাউফ।’’
অন্যত্র হযরত বায়েজিদ বুস্তামী (রঃ) বলেছেন : ‘‘আরাম আয়েশ ত্যাগ করা এবং আল্লাহ্কে পাওয়ার উদ্দেশ্যে দুঃখ কষ্টকে বরণ করাই প্রকৃত তাসাউফ।’’
মূলত: তাদের জীবন আল্লাহর আদেশ এবং রসুল (স:)এর আদর্শের উত্তম প্রকাশ করা যায়। সুফিবাদ বা সুফী দর্শন একটি ইসলামিক এমন দর্শন যা আত্মা অবস্থা সম্পর্কিত আলোচনা মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির বা তাজকিয়ায়ে নফস এর মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মুলকথা। পরম সত্তা মহান আল্লাহ কে জানার এবং চেনার আকাঙ্খা মানুষের চিরন্তন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাতিক ধ্যান ও কোর্আন হাদীসের জ্ঞানের মাধ্যামে জানার প্রচেষ্টাকে হল সূফী দর্শন বা সূফীবাদ।
বিভিন্ন সংজ্ঞা হতে এটাই প্রতিয়মান হয় যে, পবিত্র আত্মা লাভ এর জন্য সকল প্রকার কু-প্রবৃত্তি থেকে অহংবোধ বিনাস করে কুলুষমুক্ত ও সুন্দর, মনোরম জীবন গড়ে তোলাই সূফি জীবনের প্রাথমিক কর্তব্য ও প্রয়োজন। অত:পর যাহেরী ও বাতেনী উভয় জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধানের মাধ্যমে আল্লাহ্র সম্যক উপলব্ধি ও তাতে স্থিতিলাভজনিত পরম শান্তিই সুফি দর্শনের চরম লক্ষ্য।
ভক্তি ও প্রেম ব্যতীত ইবাদতের এ অবস্থান সম্ভব নয়। তাই পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব অর্জনপূর্বক আল্লাহ্র উপলব্ধি জাত জ্ঞান লাভ করে পরম সত্ত্বায় স্থিতি লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করা সুফী সাধনার মূল বিষয়বস্তু। অতএব বলা যায় যে, তাসাউফ একটা সাধারণ মানুষকে পরিপূর্ণ মানবতা দান করে আল্লাহ্র অনন্ত অসীম জ্ঞানে, জ্ঞানী করে গড়ে তোলো, যাদেরকে আমরা সুফী বলি। সুফি দর্শনের শিক্ষা তাই পরিপূর্ণরূপে মানবতারই শিক্ষা, পাশবিক স্তর হতে মানবতার স্তরে উন্নীত হবার শিক্ষা। তাসাউফ তাই মনুষত্ত্বের চরম শিক্ষা ও দর্শন।
মওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রঃ)-এর মতে এলমে তাসাউফ অর্জনের জন্য নিম্নোক্ত শর্তগুলো মেনে চলতে হবেঃ
(১) আল্লাহর সংগে পুনর্মিলনের জন্য মানবাত্মার অবিশ্রান্ত ক্রন্দন;
(২) নবী করিম (সঃ)-এর প্রতি অসীম ভালবাসা পোষণ করা;
(৩) আউলিয়া কেরামদের মাধ্যমে আল্লাহ ও রসুল (সঃ)-এর প্রেম হাসিল করা;
(৪) আল্লাহকে পাওয়ার জন্য সার্বজনীন প্রেমের আশ্রয় গ্রহণ করা;
(৫) পীর বা দীক্ষাগুরুর সমীপে যাওয়া;
(৬) দুনিয়ার মধ্যে থেকে মুক্তির সন্ধান লাভ করা;
(৭) প্রেম ও আধ্যাত্মিক সর্বক্ষেত্রে যুক্তির অবতারণা স্বীকার করা;
(৮) প্রকাশ্যভাবে জিকির আজকার করার সময় আধ্যাত্মিক সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের আশ্রয় নেয়া;
(৯) খোদার একত্বে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী হওয়া।