ইলম ও আমল

ইলম বা জ্ঞান অর্জন করা ফরয।

দ্বীন হোক দুনিয়া, ইলম ব্যাতীত মানুষ কিছুই লাভ করতে পারে না। তাই নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয।’’
কুরআন মাজিদে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : ‘‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানী লোকেরাই আল্লাহকে ভয় করে।’’ (৩৫:২৮)
পবিত্র কুরআনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে : ‘‘আর যে ব্যক্তি তার প্রভূর সামনে উপস্থিত হতে ভয় পায়, তার জন্য দু’টি বেহেশত।’’ (৫৫:৪৬)

 

যেন খোদাভীতিই বেহেশতের চাবী। আর এ খোদাভীতি ইলম বা জ্ঞানের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু ধর্মে যে, জ্ঞান অর্জনকে ফরয বলা হয়েছে, এর দ্বারা পার্থিব সমস্ত ইলমকে বুঝায় না। কেননা পৃথিবীতে নানাপ্রকার বিদ্যা রয়েছে। এ সমস্ত জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মানুষের পক্ষে যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তার জন্য ফরযও নয়। যে জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্য ফরয বলা হয়েছে, তা হলো শরীয়ত- বিশেষ করে ফরয ও ওয়াজিবসমূহের জ্ঞান লাভ করা, এর সাথে সাথে শরীয়ত বুঝার জন্য যা কিছু শিক্ষা করা প্রয়োজন, তা স্বাভাবিকভাবেই আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। যেমন মনোবিজ্ঞান, অংক, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন ব্যবসা ইত্যাদি। কেননা এ সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করা ব্যতীত মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়না। এছাড়া অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জন করা ভাল, তবে ফরয নয়।

যে জ্ঞান অর্জন মানুষের জন্য ক্ষতিকর ওঅলাভজনক, আল্লাহ্ স্বয়ং এর অনিষ্টতা বর্ণনা করেছেন। নবী করীম (সা.) এর ধরণের ইলম থেকে আশ্রয় চেয়েছেন। আল্লাহ পাক বলেন : ‘‘তারা এমন কিছু শিক্ষালাভ করে যা তাদের জন্য ক্ষতিকর এবং যা উপকারী নয়।’’ (২: ১০২)
নবী করীম (সা.) বলেছেন : ‘‘হে আল্লাহ! আমি ঐ জ্ঞান অর্জন থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি যা উপকারী নয়।’’
সুতরাং এ ধরণের জ্ঞান অর্জন করা থেকে প্রত্যেকের দূরে থাকা উচিত।

ইলম ও আমলের মধ্যে গভীর সম্পর্ক
স্মরণ রাখা উচিত যে, ইলমের সাথে আমল একান্ত আবশ্যক বা অপরিহার্য্য। ইলম ব্যতীত আমল এবং আমল ব্যতীত ইলম কোনটাই উপকারী নয়। যে ইলমের সাথে আমল নেই, তা অজ্ঞতার পর্যায়ভুক্ত। আল্লাহ তা‘য়ালা ইরশাদ করেছেন :
‘‘আহলে কিতাবের একটি সম্প্রদায় আল্লাহর কিতাবকে পরিত্যাগ করেছে যে, ঐ সম্পর্কে যেন তাদের কোন জ্ঞান নেই।’’ (২:১১০)
এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আমলহীন আলিম জ্ঞানীদের অন্তর্ভুক্ত নয়। এমন কি ঐ ইলম দ্বারা তার কোন উপকারও হয় না। যদি আমলবিহীন শুধু ইলম উপকারী বা সম্মানে যোগ্য হত, তা হলে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এটা বলা হত না।
‘‘কেন, এমন কথা বল যা তোমরা কর না, অর্থাৎ আল্লাহর নিকট এটা অত্যন্ত ক্রোধের বিষয় যে, লোকে যা বলে এটা তারা করে না।’’ (৬১:২-৩)

হাদীসে বর্ণিত আছে : ‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : পাঁচটি বিষয় উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি মুক্তি পাবে না : (১) কোন কাজে তার জীবন কাটিয়েছে; (২)তার যৌবন কিভাবে অতিবাহিত করেছে; (৩-৪) কিভাবে ধন-সম্পদ অর্জন করেছে এবং কিভাবে তা ব্যয় করেছে; (৫) ইলম অনুযায়ী সে আমল করেছে কিনা?’’
সুতরাং জেনে রাখ, আমলবিহীন ইলম কোন কাজেই আসবে না। সুতরাং এখনো সময় থাকতে জেনে রাখ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার জন্য কি কি ফরয ও ওয়াজিব করেছেন। অথচ তুমি এর প্রতি উদাসীন! এর বিপরীত কিছু বিষয় এমনও আছে যে সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভীতি প্রদর্শন করেছেন এবং তা অপছন্দ করেছেন। অথচ তুমি এর সাথে জড়িত ও এতেই নিমজ্জিত।

আমল ব্যতীত ইলম যেমন উপকারী নয়, তেমনি ইলম ব্যতীত আমলও কোন উপকারী নয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : ‘‘না বুঝে (ইলম ব্যতীত) ইবাদতকারী কলুর বলদের মত।’’
এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, না বুঝে ইবাদতকারী আবেদের মধ্যে গণ্য হতে পারে না। প্রকাশ থাকে যে, কোন ব্যক্তি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনাহারে রইল কিন্তু সে জানে না রোযা কি? অথবা কেউ তার টাকা-পয়সা দান করল কিন্তু সে জানে না এ দান-সদকার মাধ্যমে কিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। এ অবস্থায় তার কোন আমলই ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে না। এ সমস্ত কাজ ইবাদতের মধ্যে গণ্য হওয়ার জন্য জরুরী হলো এই যে, এটা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি কাজ- এ জ্ঞান হলেই চলবে না বরং আল্লাহর ইবাদত হিসেবে করার নিয়্যত হতে হবে।

শুধু এটাই নয়; বরং মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত স্বীয় ইলম অনুযায়ী আমল না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার জন্য সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয় না। ইলম অনুযায়ী আমল যত বেশী করবে, পথও ততটা উন্মুক্ত হবে। যখন আমল বন্ধ করে দিবে, তখনই তার চলার পথও বন্ধ হয়ে যাবে। হযরত ইবরাহীম আদহাম (রা.) একবার পথ চলাকালীন সময়ে রাস্তার উপর একটি পাথর দেখতে পেলেন যার উপর লেখা ছিল ‘‘আমাকে উল্টিয়ে পড়।’’ (তিনি বলেন আমি এটাকে উল্টিয়ে পড়লাম, এতে লেখা আছে : ‘‘তুমি যা জানা তদানযায়ী যদি আমল না কর তা হলে তোমার যা জানার ইচ্ছা আছে, তা জানার উৎসাহ সৃষ্টি হবে কোথা হতে?’’
ইলমের প্রকারভেদ
ইলম বা বিদ্যা দুই ভাগে বিভক্ত
العلم علمان، العلم الباطن : هو علم النافع، والعلم الظاهر هو حجة الله لبنى أدم
العلم الظاهر – هو حجة الله لبنى أدم العلم الباطن – هو علم النافع
পার্থিব বিষয় সম্পর্কিত।
পার্থিব বা সৃষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান হলো সম্পুর্ণ আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান। এ ধরণের ইলমের সীমা রয়েছে এবং তা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারণ করা থাকে। এ ইলম বা জ্ঞান যেমন অর্জন করা যায়, তেমনি বিলোপও হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
‘‘আল্লাহর জ্ঞান ভান্ডার হতে কেউ কোন কিছুই নিজের আয়ত্বে আনতে পারে না, তবে এতুটুকু সম্ভব যা আল্লাহ তাকে দেওয়ার ইচ্ছা করেন।’’(২: ২৫৫)
‘‘তোমাদেরকে খুবই কম জ্ঞান বা ইলম দান করা হয়েছে।’’ (১৭:৮৫)

আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কিত।
আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞান হলো তাঁর নিজস্ব সত্তা ও তাঁর গুণাবলী একমাত্র তাঁর সাথেই সম্পৃক্ত এবং প্রতিষ্ঠিত। তাঁর জ্ঞান অসীম ও অনন্ত। তিনি সর্ব জ্ঞানী। বিদ্যমান ও অবিদ্যমান সব কিছু সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে: ‘‘আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে অবগত আছে।’’ (২:২৩১; ৫:৯)
‘‘আল্লাহর জ্ঞান সমস্ত বস্তুকে বেষ্টন করে আছে।’’ (৬৫:১২)
‘‘তিনি (আল্লাহ) প্রকাশ্য সব কিছু সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত।’’ (৬:৭৩)

পার্থিব বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানকে ইলমে শরীয়ত বলে। আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কিত জ্ঞানকে ইলমে মা‘রিফাত বলে। ইহাকে আবার ইলমে হাকিকতও বলে। ইলমে শরীয়ত এবং ইলমে মা‘রিফাত উভয়টিই প্রত্যেক মুসলমানের জন্য শিক্ষা করা ফরয।

ইলমে মা‘রেফাত শিক্ষা করা ফরজ
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন : লিকুল্লিন জায়ালনা মিনকুম শিরআতাউ ওয়া মিনহাজা (৫ঃ৪৮)
অর্থ : তোমাদের জন্য একটি বিধি বা জীবন ব্যবস্থা এবং একটি বিশেষ পথ নির্ধারণ করে দিয়েছে।
এখানে বিধি ব্যবস্থা বলতে শরীয়ত এবং বিশেষ পথ বলতে সূফীতত্ত্বের বা তাসাউফের কথা বলা হয়েছে।
হাদীস শরীফে আছে জ্ঞান দুই প্রকার। এক প্রকার জ্ঞান হচ্ছে জবানী জ্ঞান, অন্য একটি ক্বলবী এলেম বা আত্বিক জ্ঞান। রাসুল পাক (সাঃ)বলেন : ‘‘ক্বলবী এলেম বা আত্বিক জ্ঞানই হচ্ছে উপকারী জ্ঞান।’’(মেশকাত শরীফ)।
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন : ‘‘আমি রসুল পাক(সাঃ) এর কাছ থেকে জ্ঞানের দুটি পাত্র অর্জন করেছি। একটি তোমাদের মধ্যে বিতরন করেছি অন্যটি করিনি।যদি করতাম তবে আমার তবে আমার কন্ঠদেশ কর্তিত হতো” (বোখারী শরীফ)।

জবানী এলেম হচ্ছে সে সকল বাহ্যিক জ্ঞান যথা কোরআন ও হাদিস শরীফ পড়ে বা শুনে অর্জন করা যায়। কিন্তু ক্বলবী এলেম কোন কিছু পড়ে বা শুনে অর্জন করা সম্ভব নয় । এটা এমন একটা অদৃশ্য জ্ঞান যা শুধু মাএ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে এবং একমাএ আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত একটি জ্ঞান। এই জ্ঞান অর্জন করতে হলে আমাদের ক্বলব পরিস্কার বা সুস্থ্য থাকা আবশ্যক এবং একমাএ আমাদের ক্বলবের মাধ্যমেই এই জ্ঞান অর্জন সম্ভব। তাই অনেকে এই জ্ঞানকে ক্বলবী জ্ঞান বা আত্বিক জ্ঞান বলে থাকেন। অনেকে ইহাকে ইলমে ছির বা বাতেনী জ্ঞানও বলে থাকেন। এই জ্ঞানকেই কোন কোন সুফী সাধকগন ইলমে তাসাউফ , ইলমে মারেফাত, ইলমে আসরার প্রভৃতি নামে অভিহিত করে থাকেন। পবিএ কালাম পাকে ইহাকে তাজকিয়া এবং হাদিস শরীফে ইহাকে এহসান নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

হুজুর পাক (সাঃ) এর বহুমুখি শিক্ষার মধ্যে এই তাজাকিয়াও ছিল একটি অন্যতম বিষয়। কালামে পাকে এরশাদ হচ্ছে : “তিনিই উম্মিদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরন করেছেন, যিনি তাদেরকে তাজকিয়া করেন এবং কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন। যদিও ইতিপূর্বে তারা গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।” (সুরা জুমায়া ২)
হাদিস শরীফে আছে : ‘‘যে ব্যক্তি এলেম অনুযায়ী আমল করে আল্লাহ তাকে এমন বস্তুর জ্ঞান দান করেন যা সে ব্যক্তি কখনো জানে নাই বা পড়ে নাই।”

এই হদিসের আলোকে বোধ হয় কোন মনীষি বলেছেন :
‘‘KNOWLEDGE COMES FROM GOD AND EDUCATION IS COLLECTION OF SOME INFORMATION.”
অর্থাৎ জ্ঞান আল্লাহ প্রদত্ত এবং কিছু সংখ্যক তথ্যের সমাহারকে শিক্ষা বলা হয়।

সুতরাং বই পএের মাধ্যমে আমরা যে সকল লেখা পড়া শিখেছি তা হচ্ছে শুধুমাত্র কিছু তথ্যের সমাহার। তাই হাদিস শরীফ অনুযায়ী প্রথম প্রকার বাহ্যিক জ্ঞান কে আমরা তথ্য বা INFORMATION বলেতে পারি এবং দ্বিতীয় প্রকার ক্বলবী জ্ঞানকে আমরা ইংরেজীতে KNOWLEDGE বলতে পারি।

ক্বলবী জ্ঞান বা আত্মিক জ্ঞান আল্লাহ প্রদত্ত এমন একটি অদৃশ্য জ্ঞান যাহা এলমে শরীয়ত অনুযায়ী চরিত্র গঠন ও নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী লাভ করা যায় অর্থ্যৎ আল্লাহ প্রদত্ত এমন একটি অদৃশ্য জ্ঞান যাহার মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয়, ঈমান, শরীয়ত প্রতিপালনে হৃদয় রাজ্যে নফস ও শয়তানদের প্রভাব ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে কোরআন ও হাদিস শরীফে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সে সকল বিষয় সমুহের তাৎপর্য অন্তদৃষ্টিতে অনুভূত হয় এবং হুজুর পাক (সাঃ) এর উপস্থাপিত দ্বীন প্রতিপালনে মহব্বত ও আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং শীরয়ত বিরোধী কার্যকলাপের প্রতি ঘৃনার সৃষ্টি হয়।

হজরত ইমাম মলিক (রাঃ) বলেছেন : ‘‘যিনি তাসাউফ গ্রহন করলেন কিন্তু ফিকহ গ্রহন করলেন না তিনি নিশ্চই কাফের। আর যিনি ফিকহ গ্রহন করলেন কিন্তু তাসাউফ গ্রহন করলেন না, তিনি নিশ্চয়ই ফাসেক। আর যিনি উভয় জ্ঞান গ্রহন করলেন এবং সেই অনুযায়ী আমল করলেন তিনিই মুহাক্কেক বা প্রকৃত দ্বীন গ্রহণ করলেন।”

এই জন্যই একজন বিধর্মি বা ধর্মে বিশ্বাস করেনা এমন ব্যক্তি কোরআন হাদিস বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি ধারী হলেও তাকে আলেম বা মুহাক্কেক বলা যাবে না। কারণ রসুল পাক (সঃ) বলেছেন : ‘‘আলেমগনই নবী রাসুল গণের উত্তরাধিকারী। তিনি আরো বলেন ফেরেস্তাকুল আলেমদের মহব্বত করেন এমনকি নদীর মৎসকুলও তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করে। রসুল পাক (সঃ) বলেন : “আমি আমার উম্মত অপেক্ষা যে রুপ শ্রেষ্ঠ আলেমগনও আবেদ গন অপেক্ষা সেই রুপ শ্রেষ্ঠ”।

সুতারং একজন প্রকৃত আলেম বা মুহাক্কেক হতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে ইসলামের দুই প্রকার জ্ঞানই গ্রহন করতে হবে এবং সঠিক নিয়্যতে অথার্ৎ শুধু মাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই সঠিক ভাবে তা আমাদের প্রতিপালন করতে হবে। আমাদের মৃত্যুর পর কবরের ভিতর মুনকারনাকীর দুই ফেরেস্তা যে সকল প্রশ্ন করবেন তার জবাবও শুধুমাত্র এই ক্বলবী জ্ঞানের মাধ্যমেই দেওয়া সম্ভব। তার কারণ হচ্ছে ঐ সকল প্রশ্নের জবাব অনেক বিধর্মী ও নাস্তিকের মস্তিষ্কে মখুস্ত হয়ে আছে। কিন্তু তারা জবাব দিতে পারবে না। কারণ মস্তিষ্ক প্রসুত জ্ঞান বা বাহ্যিক জ্ঞান মানুষের মৃতু্র সংগে সংগেই শেষ হয়ে যাবে। শুধু মাত্র ক্বলবী জ্ঞানই অক্ষত থাকবে এবং ঐ জ্ঞানের মাধ্যমে মুমিনগন জবাব দিতে পারবেন। তাই ক্বলবী জ্ঞান অর্জন করার প্রথম শর্তই হচ্ছে তাকে মুমিন হতে হবে। কবির ভাষায় –

”পুথিগত বিদ্যা, পর হস্তে ধন
নহে বিদ্বা, নহে ধন, হলে প্রয়োজন।”

অথবা

”যদি কাগজে লিখ নাম, কাগজ ছিড়ে যাবে,
যদি পাথরে লিখ নাম, সে নাম ক্ষয়ে যাবে।
হ্রদয়ে লিখ নাম, সে নাম রয়ে যাবে।”

কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (রঃ) বলেন : ‘‘সুফী বুজুর্গগন যে শাস্ত্রকে লাদুন্নী বলেন তা অর্জন করা ফরজে আইন। কেননা এই শাস্ত্রের ফল হচ্ছে গায়রুল্লাহর যিকির থেকে অন্তরের পরিচ্ছন্নতা, সার্বক্ষনিক উপস্থিতিতে অন্তরের মশগুল হওয়া, কুচরিত্র থেকে আত্মশুদ্বি যেমন অহমিকা, অহংকার, হিংসা, সংসার প্রীতি, জাকজমক প্রীতি, এবাদতে অলস্যতা, অবৈধ কাম বাসনা, রিয়া, খ্যাতি ইত্যাদি, এর আরো ফল হচ্ছে সচ্চরিত্রতার গুনে গুনান্বিত হওয়া, যেমন গোনাহ থেকে তওবা করা আল্লাহর ফয়সালায় সন্তষ্ট থাকা, নেয়ামতের শোকর গুজার করা বিপদ আপদে ছবর করা ইত্যাদি। এতে সন্দেহ নেই যে এসব বিষয় মুমিনের জন্য অংগ প্রতঙ্গের গোনাহ থেকেও অধিকতর কঠোর হারাম এবং নামায, রোজা, যাকাত অপেক্ষাও অধিক গুরুত্বপূর্ন ফরয। কারণ “যে কোন এবাদত খাঁটি হওয়ার নামই তাসাউফ”।’’

ইমাম গাযযালী (রঃ) বলেন : “ক্বলবী জ্ঞান বা আত্বিক জ্ঞান অর্জন করা ফরজে আইন”।
মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রঃ) ও তাসাউফ বা ক্বলবী জ্ঞানকে ফরযে আইন সাব্যস্ত করেছেন।
আল্লামা শামী (রঃ) বলেন : “কুস্বভাব দূর করার জন্য ক্বলবী জ্ঞান এতটুকু অর্জন করবে যতটুকুর প্রয়োজন তুমি নিজের জন্য অনুভব করবে।”

ইলমের সাথে গবেষণা ও চিন্তার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
ইলম এর সাথে গবেষণা ও চিন্তা অত্যন্ত জরুরী। কেননা চিন্তা ও গবেষণা ব্যতীত না মানুষের মধ্যে সঠিক উপলব্ধির সৃষ্টি হয় এবং না এটা ব্যতীত ইলম মানুষের জীবনের সুগভীর ও দীর্ঘস্থায়ী রেখাপাত করতে সমর্থ হয়। তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘‘এক ঘন্টা চিন্তা ও গবেষণা করা ষাট বছরের নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম।’’

মানবী জ্ঞানের সীমা
কোন ব্যক্তি বা পৃথিবীর সমস্ত লোক মিলেও নিজের এবং অন্যান্য লোকের নিকট জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হোক না কেন, তবুও তার জ্ঞানের একটি সীমা আছে। কিন্তু আল্লাহর নিকট যে অসীম জ্ঞান রয়েছে, এর তুলনায় মানুষের জ্ঞানের কোন মুল্যই নেই। মানুষের জ্ঞানের অবস্থা হলো এই যে, সমস্ত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েও আল্লাহর সৃষ্টি জগতের একটি অণু পরিমাণ বস্তু সম্পর্কেও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভ করার দাবি করতে পারে না। মানুষের জ্ঞান ঐ সময় পরিপূর্ণতা লাভ করে, যখন সে উপলব্ধি করে যে, প্রকৃতপক্ষে সে কিছুই জানে না। যেমন নবী করী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নিকট আরয করেছেন : ‘‘আমি তোমার যথাযথ ও সঠিক গুণাগুন ও প্রশংসা কতে অক্ষম।
আল্লাহপাক একমাত্র তাঁর নিয়ামত ও বাণী সম্পর্কে বলেছেন : ‘‘যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতের সংখ্যা গণনা করতে চাও, তবে তা গণনা করে শেষ করতে পারবে না।’’(১৪:৩৪)
‘‘আমার প্রভুর বাণী লিখার জন্য সমস্ত সাগরের পানি যদি কালিতে পরিণত হয় তবুও আমার প্রভুর বাণী লিখা শেষ হবে না। যদিও এর সাথে আরো অনেক সাগর মিলিত করা হয়।’’(১৮:১০৯)

শুধু ইলম হিদায়েতের জন্য যথেষ্ট নয়
এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, শুধু ইলম মানুষের হিদায়াতের জন্য যথেষ্ট নয়। হাকীকত ও শরীয়তের ইলম হলো হিদায়াতের মাধ্যম এবং মানুষের অভিজ্ঞতা প্রসূত জ্ঞান এতে সাহায্য করে। হিদায়েত অনুসন্ধানকারীর জন্য এ সমস্ত জ্ঞান লাভ অপরিহার্য। তাই ইলম অনুসন্ধানকারীর কর্তব্য হলো, আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানকে পথের আলো স্বরূপ মনে করবে এবং ইলম হাসিলের সাথে সাথে পরিশুদ্ধতা ও বিনয়ের সাথে আল্লাহর দিকে প্রত্যবর্তন ও হিদায়েত লাভের আশা করতে হবে। তবেই আল্লাহপাকের করুণা ও দয়ায় হিদায়েত লাভ করা যায়। যে কোন আলিম, সুফী কিংবা দরবেশ হোক না কেন, হাকীকত ও শরীয়তের ইলম সবার জন্য অতীব প্রয়োজন। এ দু‘টি ইলম ব্যতীত কাউকে আলিম, সূফী বা দরবেশ বলা যাবে না এবং ইলম ব্যতীত এগুলো কেউ দাবীও করতে পারে না।

এরপর মানুষের ইলম ও আমলের একটি প্রকাশ ও একটি অপ্রকাশ্য দিক রয়েছে। যেমন কালেমায়ে শাহাদতের প্রকাশ্য দিক হলো মুখে তা উচ্চারণ করা এবং এর সত্যতা স্বীকার করা। আর অপ্রকাশ্য দিক হলো, এর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে এতে বিশ্বাস স্থাপন করা। বাতেনী হাকীকতের অবর্তমানে প্রকাশ্য বা জাহেরী সাজসজ্জা শুধু মুনাফিকী বা কপটতা এবং বাহ্যিক আমল ব্যতীত বাতেনের দাবী করা বেদ্বীনি বা যিন্দিকী। তরীকত পন্থিগণ বাতেনহীন জাহেরকে ‘‘নাকছ’’ এবং যাহের ব্যতীত বাতেনকে ‘‘হাওয়াস’’ বলেছেন। তাই সত্য সন্ধানীর জন্য জাহের ও বাতেন উভয় দিকই অর্জন করা সমান জরুরী ও প্রয়োজন।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: