চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজা

 

ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে রোজার স্থান তৃতীয়। পৃথিবীর সকল ধর্মে কম-বেশি রোজার প্রচলক আছে। প্রতি বছর আমাদের মাঝে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পয়গাম নিয়ে উপস্থিত হয় পবিত্র মাহে রমজান। উদ্দেশ্য আমরা যেন আমাদের মনের সকল লোভ-লালসা, কামনা, বাসনা, শঠতা, হিংসা, বিদ্বেষ পরিহার করে উন্নত চরিত্র অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি। সাথে সাথে দেহ-মনকে পুত ও পবিত্র, সুস্থ ও সবল রেখে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারি। রোজা এমন একটি ইবাদত যা কেবল মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই রাখা হয়। তাই রোজা স্বভাবতই বান্দাকে আল্লাহর ধ্যান ও স্মরণের দিকে নিয়ে যায়। তাই রোজার অনুশীলন ব্যক্তির অন্তরে প্রশান্তি, তৃপ্তি এবং ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণের আশার এক অনুপম অনুভূতি সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয় বর্তমানে অনেক দুরারোগ্য রো যেমনঃ হৃদরোগ, চর্ম রোগ, বাত, কোষ্ঠকাঠিন্য, স্থূলকায় রোগী, জ্বর, শ্বাসকষ্ট রোগ ইত্যাদি নিরাময়ে রোজা রাখার উপদেশ দেয়া হচ্ছে। রোজা এই সমস্ত রোগের কষ্ট দূর করে। রোজা রাখার ফলে শরীরের মধ্যস্থিত অনেক ক্ষতিকারক টক্সিনের বিষক্রিয়া থেকে শরীর রক্ষা পায়। এ অতি স্বাভাবিক ও অত্যন্ত কার্যকরী এই পন্থায় দেহাভ্যন্তরে বিধৌত ও পরিচ্ছন্ন হয়। আমাদের পূর্ব পুরুষগণ এ সম্পর্কে অনেক ত্যাগ রাখতেন। তাই জ্বর হলে বলতেন “জ্বর হলে খেওনা, তাহলে ও ছুটে পালাবে”। বাস্তবিকই প্রাকৃতিক চিকিৎসায় এই আধুনিক পদ্ধতি অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আজকের আলোচনায় রোজা সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার ইচ্ছা রাখি।

প্রখ্যাত স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ডাঃ শেলটন তার “সুপিরিয়র নিউট্রিশন” গ্রন্থে বলেছেন- উপবাসকালে শরীরের মধ্যস্থিত, প্রোটিন, ফ্যাট ও শর্করা জাতীয় পদার্থসমূহ স্বয়ং পাচিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোতে পুষ্টি বিধান হয়। এই পদ্ধতিকে “এ্যান্টো লিসিস” বলা হয়। এর ফলে শরীরে উৎপন্ন উৎসেচকগুলো বিভিন্ন কোষে ছড়িয়ে পড়ে। এটি হচ্ছে শরীর বিক্রিয়ার এক স্বাভাবিক পদ্ধতি। রোজা এই পদ্ধতিকে সহজ, সাবলীল ও গতিময় করে। ভেষজের জনক হিপ্লোক্র্যাটন দু’ হাজার চারশ’ বছর আগে বলেছিলেন “খাদ্য তোমার রোগের ওষুধ”। অর্থাৎ খাদ্যকে আয়ত্ত করার মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ হতে মুক্তি পাওয়া যায়। আর এই আয়ত্ত করার অন্যতম মাধ্যম হলো রোজা। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ওষুধ ও শল্য চিকিৎসার প্রখ্যাত ডাঃ অ্যালেকসিস বলেছেন, পুনঃ পুনঃ নিয়মিত এবং বেশি পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ এমন এক শরীর বৃত্তয় ক্রিয়ায় বাধাদান করে যা মানব প্রজাতির ঊর্ধ্বতন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রোজার উপবাসের মাধ্যমে লিভার রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয় ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশীর প্রোটিন, গ্রন্থিসমূহ এবং লিভারে কোষসমূহ আন্দোলিত হয়। আভ্যন্তরীণ দেহ যন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং হ্নদপিণ্ডের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেহাংশগুলোর বিক্রিয়া বন্ধ রাখে। খাদ্যাভাব কিংবা আরাম-আয়েশের জন্য মানুষের শরীরের যে ক্ষতি হয়, রোজা তা পূরণ করে দেয়। এ ছাড়া মানুষের শরীরে থাকে অনেক ধরনের রোগ। এ রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রেও রোজা অনেক উপকার করে। যেমনঃ-

বহুমূত্র রোগঃ মোটা লোকের বহুমূত্র রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রোজা খুব উপকারী। ডাক্তারী পরীক্ষায় দেখা গেছে, একাধারে ১৫ দিন রোজা রাখলে বহুমূত্র রোগের অত্যন্ত উপকার হয়। চর্বিযুক্ত বস্ত্রমূত্র রোগীকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ওজন কমাতে বলা হয়েছে। কোন ওষুধ না খেয়ে শুধুমাত্র রোজা রাখার মধ্যমেও বহুমূত্র রোগ নিরাময় হয়।

চর্মরোগঃ রোজা চর্ম রোগের জন্য খুবই উপকারি।পুষ্টির সঙ্গে চর্মরোগের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। তাই চর্ম রোগের কিংবা ত্বকের উপর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় রোজা খুবই ফলদায়ক পদ্ধতি। আধুনিক চিকিৎসকগণ এমত পোষণ করে থাকেন।

কিডনীর পাথর কণা ও চুনঃ অনেকের কিডনী সমস্যা আছে। অথবা কিডনীতে পাথর ও চুন হয়। রোজা রাখলে এ সমস্যা আরো বেড়ে যাবে বিধায় তারা রোজা রাখেন না। অথচ আধুনিক ডাক্তারগণ বলেছেন রোজা রাখলে কিডনীতে সঞ্চিত পাথর কণা ও চুন দূরীভূত হয়। রোজাদারগণ যদি বেশী পানি পান করে তাহলে প্রস্রাবের নালি ধুয়ে পরিষ্কার হয় এবং নালি পথ প্রশস্ত হওয়া ছোট পাথর কণা নিঃসরণে সুবিধা হয়।

ধমনীতে উচ্চচাপ জনিত কষ্টঃ রোজা রাখলে শরীরের ওজন কমে। শরীরের মধ্যে যে সমস্ত লবণ প্রবেশ করে সেই লবণগুলি রক্ত চাপ বাড়ায় তাই রোজা সেই লবণের পরিমাণ কামায় ফলে হ্নদপিণ্ডের উপর চাপ কম হয়। যে সমস্ত রোগী ধ্বমনিতে উচ্চ চাপের জন্য কষ্ট পাচ্ছেন তাদেরকে দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ কমাতে হবে। এতে রোজার বিকল্প নেই। সুতরাং বুঝা গেল রোজা ধ্বমনিতে উচ্চচাপ জনিত কষ্ট দূর করে।

ওজন বৃদ্ধিঃ এটা কোন জটিল রোগ নয় বরং অনেক রোগের কারণ। প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য মানুষের দিনে তিন বার খাবার প্রয়োজন। বার বার খাদ্য গ্রহণ ফলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, অতিরিক্ত খাদ্য চর্বি হিসাবে দেহে জমা হয়, ফলে ব্যক্তির ওজন বৃদ্ধি পায়। পেশি সঞ্চালন হয় না বললে চলে। রক্তচাপ বাড়ে তাই মোটা লোকেরা ধ্বমনির উত্তেজনা জনিত বহু কষ্টে ভোগে। তাছাড়া ওজন বৃদ্ধি শ্বাস কষ্ট সৃষ্টি করে, ফুস ফুস ও হ্নদপিন্ডকে দুর্বল করে। তাই রোজা উক্ত রোগের সর্বোত্তম প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে।

স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধিঃ স্নায়ুতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং স্মৃতি শক্তি ও একাগ্রতা বৃদ্ধি করতে রোজা বিশেষ উপকার করে। চিকিৎসকগণের মতে স্নায়ুতন্ত্রের উপর রোজার ক্রিয়া মরিচা পরিষ্কার করার জন্য লোহার ব্রাশের মত। রোজা স্নায়ুতন্ত্রে কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে, তাই রোজা জীবনের অনেক অনেক মারাত্মক রোগ দূর করতে সক্ষম।

অন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগঃ রোজা হল অন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগের উত্তম নিরাময় পদ্ধতি আমিষ ও শর্করা জাতীয় খাদ্য গেঁজে ওঠার ফলে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। রোজা রাখলে অন্ত্রে সঞ্চালন হয় এবং বিভিন্ন পাচক রস নিঃসৃত হয় ফলে আন্ত্রিক সময়ের জন্য তৎপর রাখে। ফলে তার কর্ম ক্ষমতা কমে যায় ও খাদ্য পরিপাকে অক্ষম হয়ে পড়ে। এ জন্য খাদ্য গেঁজে ওঠে ও কতগুলো উত্তপ্ত গ্যাস উৎপন্ন হয়। রোজা উক্ত খাদ্যকে পাচিত করে তাই উপরোক্ত ব্যাধি হতে রোজা দ্বারা সহজে নিরাময় পাওয়া যায়।

মেদ বৃদ্ধি জনিত রোগঃ মেদ বৃদ্ধি জনিত রোগ নিরাময়ে রোজা উত্তম চিকিৎসা। মেদ বৃদ্ধি বিশেষতঃ রক্তে কোলেষ্টল বেশী হলে হ্নৎপিন্ড ধমনির উপর বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ধমনির অন্যান্য রোগ যেমন-থ্রম্বসিস হয়। যার কারণে রোগীর হঠাৎ মৃত্যু হতে পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্যঃ যারা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভোগেন, রোজা তাদের জন্য খুবই উপকারী। এক রাতে তিনবার আহার করায়,প্রচুর শরবত পান করায় এবং যথেষ্ট বুট ভাজা দিয়ে ইফতারি করায়, সাধারণত কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে যায়।

স্থূলকায় রোগীঃ রোজা দ্বারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় স্থূলকায় লোকেরা। উচ্চবিত্ত পরিবারে কিছু সংখ্যক স্থূলকায় লোক দেখা যায়, যারা শুধু ভালো ভালো খাবার পছন্দ করে, বার বার খায় এবং শুধু খাওয়ার জন্যই তারা বেঁচে থাকে। ফলে তাদের শরীরে চর্বি জমা হয় এবং তারা এক পর্যায়ে অস্বাভাবিক মোটা হতে থাকে। এই চর্বি যে শুধু চামড়ার নিচেই জমা হয়, তা নয়, বরং চর্বি কোলেস্টরল আকারে শিরা-উপশিরা, ধমনী এবং হ্নদপিন্ডে জমা হয়। ফলে তাদের শরীরে রক্ত চলাচলে ব্যাহত হয়। ফলে এক দিকে উচ্চ রক্ত চাপের সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে শরীরের টিসুগুলো ঠিকমত পুষ্টি পায় না, যার জন্য রোগীর ভোগান্তি চলতে থাকে। এই ধরনের লোকের জন্য রমজানের রোজা অত্যন্ত উপকারি। রোজার দিনগুলোতে বাধ্যতামূলক অনাহারের ফলে শরীরের জমানো কোলেস্টেরলগুরো শরীরের কাজে ব্যবহ্নত হয়ে পরিমাণে কমে যায়। যার ফলে রক্তের সার্কুলেশন স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং এতে রোগীর রোগ বৃদ্ধি পায়। মাহে রমজানুল মোবারক আসলেই অনেকে চিন্তায় পড়ে যান এই কারণে যে, রোজা রাখলে নাকি স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রোজায় কারো স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে বা রোজা রেখে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কোনও রোজ দারের মৃত্যু হয়েছে, এমন কোন ঘটনা ঘটেছে বলে অন্ততপক্ষে আমার জানা নেই। রমজান মাসের পরে দেখা যায় যে, যার যেরূপ স্বাস্থ্য ঠিক সেইরূপ আছে। এর পিছনে কারণও আছে। আসলে রোজার দিনে আমরা যে খুব একটা কম আহার করছি তা নয়, বরং কিছুটা ভালো ভালো এবং পুষ্টিকর খাদ্য খাচ্ছি। অন্য সময়ের মতো রোজার দিনে আমরা ৩ বারই আহার করি। পার্থক্য শুধু সময়ের ব্যবধানে। রমজান ভিন্ন অন্য মাসে আমরা ৬ থেকে ৮ ঘন্টার ব্যবধানে খানা খেয়ে থাকি, যা স্বাস্থ্যসম্মত। কিন্তু রোজার সময় সাহরি থেকে ইফতারি পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান দাঁড়ায় ১৩ থেকে ১৪ ঘন্টা, যার জন্য আমাদের সাময়িক কষ্ট ভোগ করতে হয়। কিন্তু এর মধ্যে একদিকে যেমন আমরা ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করি, তেমনি অর্থাভাবে, অনাহারে থেকে গরীবরা ক্ষুধার জ্বালায় কিরূপ কষ্ট পায় সেটা অনুভব করা সহজ হয়। পাশাপাশি তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার সৎ ইচ্ছা জাগ্রত হয়। যা আমাদের উপর রোজা ফরয হওয়ার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য। তাই আমাদেরকে রোজার উদ্দেশ্যের কথা স্মরণে রেখে যথানিয়মে মাহে রমজানের রোজাগুলো রাখতে হবে। তা না হলে পরজগতে আল্লাহর বিধান অমান্য করার অপরাধে আমাদের অপরাধী হয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: