হাদীসে হাদীছে কুদসীতে এসেছে- আল্লাহপাক ছিলেন গুপ্তধন। তিনি নিজেকে পরিচিত করার জন্য মহাবিশ্ব এবং আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের হিদায়েতের জন্য তিনি নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে দ্বীন প্রেরণ করেছেন। সেই দ্বীনে সন্নিবেশিত নামাজ-রোযা, বিয়ে-শাদী, রাজনীতি-অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদসহ যাবতীয় জাহিরী আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধানের সমষ্টিই হচ্ছে শরীয়ত। চিন্তা-বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়কে আকাইদ, জাহিরী আমল সংক্রান্ত বিষয়কে ফিকহ বা শরীয়ত এবং বাতিনী আমল সংক্রান্ত বিষয়কে তাসাউফ বলে। ইলম ও আমল দুই প্রকার: ক) জাহিরী বা শারীরিক, যা ইসলামের ৫টি রুকন ও শরীয়ত সম্বলিত খ) বাতিনী বা ক্বালবী, যা ঈমানের ৭টি রুকন এবং তরীকত, হকীকত ও মারিফত সম্বলিত জাহিরী আমলের সম্পর্ক দেহের সাথে আর বাতিনী আমলের সম্পর্ক দিলের সাথে। জাহির ও বাতিন সুন্দর হবে যার,আল্লাহ হাসিল হবে তার। নিশ্চয়ই দেহের মধ্যে এক টুকরা গোশত আছে, যখন তা শুদ্ধ হয়ে যায় সারা দেহ শুদ্ধ হয়ে যায় এবং যখন তা অশুদ্ধ হয়ে যায় সারা দেহ অশুদ্ধ হয়ে যায়, আর সেটা হলো ক্বালব” – আল-হাদীছ।
দিল থেকে দূরাশা, লোভ, কৃপণতা, হারাম, পরনিন্দা, মিথ্যা, হিংসা, অহংকার, ভণ্ডামী, আক্রোশ, আত্মগরীমাসহ বদগুণাবলী সমূহ দূর করা এবং তওবা, ইনাবাত, যুহদ, অরা, শোকর, তাওয়াক্কুল, তসলীম, রেজা, সবর, কানায়াতসহ সৎগুণাবলী সমূহ দিলে অর্জন করার পদ্ধতিকে তরীকত বলে। আর এই তরীকতের আমলসমূহ যথাযথভাবে পালন করার দ্বারা অন্তরে যে নূর সৃষ্টি হয় তাকে হকীকত বলে। অতঃপর আল্লাহ পাকের সঙ্গে গড়ে উঠা সম্পর্ককে মারিফত বলে এবং এ পর্যায়ে উত্তীর্ণ ব্যক্তিকে আরিফ বা সূফী বলে। যাঁরা মাটির তৈরী মানুষ হয়েও মর্যাদায় আগুনের তৈরী জীন এবং নূরের তৈরী ফেরেশতার উর্দ্ধে উঠতে সক্ষম হন। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও মাস্টার ডিগ্রী অর্জন করলে বিদ্যায় পূর্ণতা লাভ হয়। তেমনি দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল পাশ করলে ইলমে পূর্ণতা লাভ হয়। অনুরূপভাবে শরীয়ত,তরীকত, হকীকত ও মারিফতের মাধ্যমেই আমলে কামালিয়াত হাসিল হয়। এক্ষেত্রে হক মুর্শিদগণের শিক্ষা এবং ওলীগণের লিখিত কিতাবী দীক্ষা নেয়া আবশ্যক।
শরীয়ত, তরীকত, হকীকত, মারিফত, তাযকিয়া, ইহসান সবই একে অপরের পর্পিূরক। যথাযথভাবে সবগুলোর চর্চা করলেই কেবল আল্লাহকে পাওয়া সম্ভব। যেমনটি শিক্ষা দিয়ে গেছেন মহানবী (সা.), সাহাবায়ে কিরাম (রা.), হক তরীকা ও মাযহাবের ইমামগণ। যে কোনো এক বা দুটিতে ডুবে থাকলে ধোকায় পড়তে হবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে এ নিয়ে চরম ভুল বোঝাবুঝি চলছে। কেউতো শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাতসহ কিছু জাহিরী আমলেই সারা জীবন কাটাচ্ছে। আবার কেউতো নামাজ-রোজাসহ অনেক শরয়ী আমলকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কিছু রুসূমী যিকির ও তরীকাহীন উৎসব পালনকেই তাসাউফ মনে করছে। আবার অনেকে নর-নারী মিলে নেশা পান, গান-বাজনা ও কবর সাজানোকেই মারিফত ভাবছে। আবার কেউতো মূল তাসাউফকে অস্বীকার করার মত চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন করতঃ আওলিয়া কেরামের শানে বেয়াদবীমূলক কথাবার্তা বলছে। অথচ ওলীগণের মাধ্যমেই দেশে হক দ্বীনের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। ধনবল জনবল কিংবা বাহু বলে নয় বরং তাঁরা আত্মিক বলে বলিয়ান হয়ে তাগুতী শক্তিকে পদদলিত করে দ্বীনে হককে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং লাখো লাখো বিধর্মীকেও দ্বীনদার বানিয়েছেন। তাঁদেরকে বাঘে, মাছে, বাতাসে এমনকি কুমিরে পর্যন্ত বহন করেছে। সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ হয় যার, সারা জগৎ হয়ে যায় তার।
বিদায় হজ্জে আরাফাতের ময়দানে শেষ ওহী নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহপাক পূর্ণ দ্বীনকে ৩ ভাগে বর্ণনা করেছেন যথা: ক) কামিল দ্বীন বা ইহসান খ) পূর্ণ নিয়ামত বা পরিপক্ক ঈমান গ) দ্বীনে রাজী বা ইসলামী শরীয়ত। একদা রাসূল (সা.) এর সামনে জিবরাইল (আ.) দ্বীন শিখাতে এসে পূর্ণ দ্বীনকে ৩ ভাগে ব্যাখ্যা করেছেন যথা: ক) ইসলাম অর্থাৎ শরয়ী বিধি-বিধান বা দৈহিক আমল খ) ঈমান অর্থাৎ আকাইদ ও বিশ্বাস বা আত্মিক আমল গ) ইহসান অর্থাৎ তাসাউফ বা মারিফত। পরকালে উত্তম দল হবেন মুহসিনগণ (নিস্পাপ নবী-ওলী) যাঁরা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবেন এবং অন্যদের জন্য সুপারিশ করবেন এমন কি আল্লাহর দীদারও পাবেন। মধ্যম দল হবেন মুমিনগণ(যাঁদের নেকী বেশী গুনাহ কম) তাঁদের হিসাব হবে কিন্তু জাহান্নামের আযাব ছাড়াই জান্নাতে যাবেন। অধম দল হবে মুসলিমগণ (যাদের গুনাহ বেশী নেকী কম) তাদের হিসাব দিতে হবে এবং নেকীর কমতি পরিমাণ জাহান্নামে আযাব ভোগের পর জান্নাতে যাবে। আর নরাধম দল হবে: নাস্তিক, মুনাফিক, কাফির, মুশরিক ও ফাসিকগণ (যাদের যার্রা পরিমাণ ঈমানও নেই, নেকীও নেই।) তারা অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। তাদের জন্য কেউ সুপারিশ করবে না।
ক্বালবী আমল না করে শুধু লোক দেখানো কিছু শারীরিক আমল নিয়ে থাকলে ক্বালব মুর্দা হয়ে যায়। ক্বালবে আল্লাহর যিকির না থাকায় তা শয়তানের আখড়ায় পরিণত হয়। যার দিলে যিকির জারী হয় না, তার পেছনে নামাজও শুদ্ধ হয় না। যারা শুধু শরীয়ত বা জাহিরী আমল নিয়েই থাকে, তাদের ক্বালব, রূহ, সের, খফী, আখফা, নফস,আব, আতশ, খাক ও বাদ এই দশ লতিফায় আল্লাহর যিকির জারী হয় না। তাই তারা ইনসানে কামিল না হয়ে শুধু নামধারী মুসলমান হয়ে জীবন কাটায়। আল্লাহর ভয় ও রাসূল (সা:) এর মহব্বতে তাদের কান্না আসে না। জাহিরী ইলম ও আমলের জন্য যেমন যোগ্য শিক্ষক ধরা এবং জাহিরী বই পড়া ফরজ, তেমনই বাতিনী ইলম ও আমলের জন্য যোগ্য মুর্শিদ ধরা এবং বাতিনী বই পড়া ফরজ। জগতের সবকিছুই সর্বদা আল্লাহর যিকিরে মশগুল। তাই হক তরীকার আমল ও নিয়মিত যিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে হবে। তবে বাতিল ও ভণ্ডদেরকে সর্বদাই পরিত্যাগ করতে হবে। তারা আপন স্বার্থে অশ্লীল ও বেশরা কর্মের মাধ্যমে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। তারা শরীয়তের বরখেলাফ কাজের মাধ্যমে মানুষকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়। তাসাউফহীন আলেম, ভন্ড দরবেশ এবং মুর্খ সূফী থেকে সর্বদা দূরে থাকতে হবে।
বর্তমানে অনেক মানুষ অজ্ঞতার কারণে তাসাউফকে অবহেলা করে থাকে। অথচ তাবলীগ জামায়াতের প্রবর্তক মাওলানা ইলিয়াস (র.), মাওলানা যাকারিয়া (র.); সালাফী মতবাদের শায়খ ইমাম ইবন তাইমিয়া (র.), ইমাম ইবনুল কাইয়িম (র.); মাওলানা মওদুদী (র.) ও মাওলানা আব্দুর রহীম (র.) প্রথমে তাসাউফ সম্বলিত দ্বীনী খেতমত শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতৈ তাঁদের অনুসারীগণ তাঁদের পথ থেকে দূরে সরে গেছে। ইমাম গায্যালী (র.), আল্লামা রূমী (র.), ড. ইকবাল (র.), ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (র.), মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (র.), আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ শফী (র.), সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (র.), দেওবন্দ ও হাটহাজারীর আকাবিরসহ বিশ্ব বরেণ্য মুহাক্কিক আলিমগণ নিজেরা শুধু তাসাউফী মুজাহাদা করেই ক্ষান্ত হননি বরং তাঁরা তাসাউফের উপর অসংখ্য গ্রন্থও রচনা করে গেছেন। মাওলানা ভাসানী (র.) হক কথা ও হাফেজ্জী হুজুর (র.) তওবার ডাক দিয়েছেন। দ্বীনের শুরু শরীয়ত দিয়ে আর দ্বীনের পূর্ণতা মারিফত দিয়ে। তাই আসুন আমরাও তওবা করতঃ তরীকার যিকিরের মাধ্যমে আল্লাহকে চিনতে এবং বিনা হিসাবে জান্নাত ও আল্লাহর দীদার লাভের যোগ্যতা অর্জনে সচেষ্ট হই।