নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সঃ)-এর অবধান কি? এবং একজন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে আমার দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য কি।2

 

 
 
ভূমিকাঃ- আলোকিত পৃথিবীতে নারীর অবদান সবচাইতে বেশী। নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজুড়ে আলোচনা সমালোচনার শেষ নেই। অথচ এই নারীকে মহিমান্বিত কে করেছে তা এখনো অনেক নারী অবগত নন। ফলে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পৃথিবীতে ইসলামই সর্বপ্রথম নারীদের যথাযোগ্য সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলাম পূর্বযুগে নারীদের মানুষ হিসেবে গন্য করা হতো না। স্ত্রী হিসেবে তারা ছিল চরম অবহেলার স্বীকার। কন্যা সমত্মান জন্মগ্রহণকে সামাজিক কলঙ্কের বোঝা মনে করে জীবমত্ম কবর দেয়া হতো। সমাজে নারী জন্ম নেয়া ছিল অভিশাপ। ইসলামের আগমনে নারীর প্রতি এ জঘন্য অত্যাচারের অবসান ঘটে। নারীর জীবনে আসে অনেক পরিবর্তন। মহানবী সা. এর মাধ্যমে নারীজাতি ধর্মে কর্মে, শিক্ষাক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে, পারিবারিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এভাবে প্রত্যেক ক্ষেত্রে ফিরে পেয়েছে তাঁদের সম্মান মর্যাদা ও অধিকার। আলাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ঘোষণা দেন। এভাবে ইসলামই সর্বপ্রথম নারীদেরকে সমাজে স্বাধীন, সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার পথ প্রদর্শন করে।
 
নারীর পরিচয়ঃ- নারীদের সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে নারীর সংজ্ঞা বা নারী বলতে আমরা কি জানি তা আমাদের জানা থাকা আবশ্যক। المرأة শব্দটি المرء শব্দের স্ত্রী লিঙ্গ, অর্থ নারী। শব্দটি একবচন, এর কোন বহুবচন হয় না। তবে অপর শব্দ থেকে এ শব্দের বহু বচন হল نساء (নিসা)। অর্থাৎ নারী হল তারা যাদের আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মূলত: আল্লাহ তা‘আলা নারীদের পুরুষ হতেই সৃষ্টি করেছেন, যাতে তাদের পারষ্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় ও গভীর হয় এবং তাদের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা ও দয়া-অনুগ্রহ যেন হয় অতীব সুন্দর ও মধুময়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। (সূরা আন-নিসা: ১)
 
জাহেলী যুগে নারীর অবস্থাঃ- ইসলামপূর্ব জাহিলিয়্যাতের যুগে নারী জাতির কোন মূল্য ছিল না। বরং নারী সত্তাটাকেই পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, বংশের জন্য কলঙ্ক, অপমান ও অভিশাপ মনে করা হত। আর তৎকালীন আরব সমাজের নারীদের করুণ অবস্থা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তাদের মুখ কাল হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দু:খে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দেবে, না তাকে মাটির নীচে পুতে ফেলবে। শুনে রাখ, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট।'' (সূরাহ নাহল, আয়াত: ৫৮-৫৯)
 
প্রাচীনকালে নারীর মর্যাদাঃ- প্রাচীন মানব ইতিহাসের আলোচনায় নারীর অবস্থানের যে চিত্র পাই তা হচ্ছে অকথ্য নির্যাতনের চিত্র যেখানে নারীকে শুধু সন্তান উৎপাদনের একটা যন্ত্র বা ভোগের পণ্য হিসেবে গণ্য করা হতো। এমনকি তৎকালীন সভ্য সমাজ নামে খ্যাত গ্রীক, রোমান ও খ্রিষ্ট সমাজে ও নারীর কোন সামাজিক মর্যাদা বা অধিকার ছিল না।নারী সভ্যতার সুতিকাগার গ্রীসে নারী জাতিকে শয়তানের সমতুল্য মনে করা হত এবং গ্রীসবাসীরা নারীর অবমাননা বৃদ্ধিতে কম প্রচেষ্টা চালায়নি। সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে গ্রীক নারীদের স্থান ছিল অত্যন্ত নিচে। ব্যবিলন ও ইরানের অবস্থাও রোম ও গ্রীক হতে ভিন্ন ছিল না। নারীকে এসব সমাজে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হত।প্রাচীনকালে সকল প্রাচ্য জাতিসমূহের মধ্যে বহুবিবাহ একটি স্বীকৃত বিধি। রাজকীয় লোকদের দ্বারা এই বিধির অনুশীলন সর্বত্র ঐশী মর্যাদায় অভিষিক্ত হতো এবং জনগণের কাছে তার অনুসরণ পুতঃপবিত্র বলে পরিগণিত হতো।
 
আধুনিক যুগে নারীর অবস্থানঃ- আধুনিক যুগে নারী স্বাধীনতার চিৎকার সত্ত্বেও নারীদের সঙ্গে বিভিন্ন দিক হতে প্রতারণামূলক ব্যবহার করা হচ্ছে। জাহিলী যুগের অনুকরণে বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় তথাকথিত কিছু নারীলোভী যৌনবাদী বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন প্রকার রসালো ও আকর্ষণীয় শ্লোগানের মাধ্যমে নারীজাতিকে ঘর থেকে বাইরে এনে নারী স্বাধীনতার নামে যা কিছু করছে, তাকে নারী স্বাধীনতা বলা যায় না, বরং তা নারীর সম্ভ্রম হরণ ছাড়া আর কিছু নয়। সেসব কুমতলবীদের প্ররোচনায় নারীরা আজ মাঠে ময়দানে, হাটে বাজারে, নগরে বন্দরে পথের ধারে, গলির মোড়ে ওপেন হয়ে গিয়েছে। তারা পর্দাতো দুরে নিক্ষেপ করেছেই, উপরন্তু তাদের পোশাকের দৈর্ঘ-প্রস্থ কমতে কমতে শরীরের মধ্যভাগে এসে ঠেকেছে। আর এর দ্বারা সে নারীবাদী লম্পটরা স্বার্থসিদ্ধি করেছে। ফলে যে নারী ছিল এক পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী, সে এখন পথে ঘাটে সবার জন্য সর্বাঙ্গিনী। কারণ, তাকে এখন শুধু এক স্বামীর মন যোগালে চলে না, বরং অফিসের বড় সাহেব, ম্যানেজার ও বসের মনও যোগাতে হয়। যে নারীর অঙ্গ থাকা উচিত হিজাব ও বোরকা দ্বারা আবৃত, সে নারীকে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নামে দু টুকরো কাপড় ছাড়া আর কিছুই রাখতে দেয়া হয় না। আর এ সকল বেহায়পানার যতাকলে নারীর জীবনকে আজ দুর্বিসহ করে তোলা হয়েছে। যদ্দরুণ আজ নারী সর্বত্র নিরাপত্তাহীনবতায় ভুগছে। নারীকে যত্রতত্র নির্যাতন করা হচ্ছে, ইভটিজিং করা হচ্ছে, লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। নারী হচ্ছে যৌনদস্যুদের লালসার শিকার। হচ্ছে এসিড সন্ত্রাসের শিকার, কিংবা হত্যাযজ্ঞের শিকার। তাই বলা যায় আধুনিক সভ্যতা নারীকে যে স্বাধীনতা দিয়েছে, তা প্রতারণা ও কৃত্রিমতা ছাড়া কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা স্বাধীনতা নয়, বরং তা প্রাচীনকালে নারী নিগ্রহের চেয়েও ভয়বহ।
 
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নারী অধিকারঃ-
*হিন্দু ধর্মমতেঃ- হিন্দুদের ধর্মীর গ্রন্থ বেদ নারীর জন্য নিষিদ্ধ। ভারতে নারীর যে স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকার করা হতো না, সতীদাহ প্রথাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হিন্দুদের মধ্যে বহুবিবাহ উভয়দিক থেকে অতি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রাচীন মিডীয়, ব্যবিলনীয়, অ্যাসিরীয় ও পারসিকদের মধ্যেও আপাতদৃষ্টিতে একজন পুরুষ কয়জন নারীকে বিবাহ করতে পারবে সে বিষয়ে কোন বাধা-বন্ধকতা ছিল না। এমন কি আধুনিক যুগেও একজন উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ যে কয়টি স্ত্রী গ্রহণ করতে চায় তার অধিকার তার রয়েছে।
 
*বৌদ্ধ ধর্মমতেঃ- নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারীর জন্য নির্বাণের কোন উপায় নেই। মুসা (আ.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে ইসরাইলীদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। তারা একজন হিব্রু স্বামী কয়টি স্ত্রীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে সে বিষয়ে কোন সীমা নির্ধারণ না করেই এই প্রথা অনুসরণ করতো। পরবর্তীকালে জেরুজালেমের তামুদগণ স্বামীর পে যথাযথভাবে স্ত্রীর ভরণপোষণের শক্তির ওপর স্ত্রী গ্রহণের সংখ্যা নির্ধারণ করেছিল। যদিও ইহুদী পুরোহিতরা উপদেশ দিতেন যে, চারটির অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা যাবে না। তবু কেরাতিগণ তাদের সঙ্গে একমত ছিলেন না এবং তারা সীমা নির্ধারণের বৈধতা স্বীকার করতেন না। ধর্ম পারসিকদেরকে বহু বিবাহের জন্য উৎসাহিত করতো।
 
*খৃষ্টান ধর্মমতেঃ- একমাত্র নারীই মানবীয় পাপের জন্য দায়ী। সন্তজম ক্রাইম ষ্টম বলেন: নারী একটি অনিবার্য পাপ, একটি জন্মগত দুষ্ট প্ররোচনা। সমস্ত বর্বর পশুর মধ্যে নারীর মত ক্ষতিকর আর কিছুই নেই। টারটুলিন তার লিখিত একখানি গ্রন্থে জনসাধারণের অনুভূতিকে রূপ দিয়েছেন। যেখানে তিনি নারী জাতিকে “শয়তানের দ্বার, নিষিদ্ধ মোহর উন্মক্তকারী, ঐশী আইনের প্রত্যাখ্যানকারী, খোদার প্রতিবিম্ব, মানুষের ধ্বংসকারী হিসাবে বর্ণনা করেছেন। ইংল্যান্ডের প্রাচীন আইনে পুরুষকে নারীর মালিক বলা হয়েছে। এমনকি স্বামী স্ত্রীকে হত্যা পর্যন্ত করতে পারত। পুরুষ এবং নারী একইরকম অপরাধ করলে নারীকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ ছিল এবং পুরুষের জন্য ছিল সামান্য শাস্তি। বর্তমান সময়ে ও ইংল্যান্ডের আইনে এমন অনেকগুলো দিক আছে, যাতে মনে হবে নারী পুরুষের দাসী। এখনো গীর্জায় বিয়ের সময় নারীকে শপথ নিতে হয় যে, সে সারাজীবন স্বামীর অনুগত থাকবে। দাসত্ব, অধীনতা এবং ঘৃণা লাঞ্ছনার ফলে নারীর মন থেকে আত্মসম্মানের অনুভূতি মিটে গিয়েছিল। পৃথিবীতে যে সে কোন অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এবং তার জন্য কোন সম্মানের স্থান আছে, একথা সে ভুলে গিয়েছিল। পুরুষ তার উপর অন্যায়- অত্যাচার করাকে অধিকার মনে করত এবং নারী এসব পীড়ন সহ্য করাকে তার কর্তব্য মনে করত। তার মধ্যে দাসত্বের মনোভাব এমনভাবে বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছিল যে, সে নিজেকে স্বামীর দাসী বানাতে গর্ব অনুভব করত এবং পতি আরাধনা তার ধর্ম ছিল।
 
ইসলাম তথা হযরত মুহাম্মদ (স)- এর অবধানঃ- এবার আমরা দেখব ইসলামে নারীর অধিকার কী? তার অবস্থান কোথায়? এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা কী? একজন নারীকে তার পূর্ণ জীবনের সামগ্রিক সময়টা ভাগ করলে দেখতে পাই যে, সে পর্যায়ক্রমে প্রথমে কন্যা, স্ত্রী এবং মাতার ভূমিকা পালন করে থাকেন এবং অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গেলে প্রথমেই আসে তার শিক্ষার অধিকার, তারপর পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিক অধিকার, বিবাহের অধিকার, কর্মেক্ষেত্রের অধিকার, অভিন্ন আইনের অধিকার এবং মত প্রকাশ এবং পরামর্শের অধিকার।
 
কন্যা হিসাবে নারীর অধিকার ও অবস্থান:- আইয়ামে জাহেলিয়া তথা অন্ধকার যুগে কন্যা সন্তান ছিল লাঞ্ছনা ও অবমাননার পাত্র। জীবন্ত কন্যাকে তারা মাটিতে পুঁতে রাখতে সামান্য দ্বিধাবোধ করত না। কারো কন্যা সন্তান ভুমিষ্ট হলে কন্যার মাতা- পিতা লজ্জায় শির অবনত করে রাখতো। কারণ তারা মনে করত এই কন্যা দ্বারা তারা কখনোই কোন সৌভাগ্যের দ্বার উন্মোচন করতে পারবে না। বরং এই কন্যার (বৈবাহিক সূত্রে) জন্যই তাদেরকে অন্য কোন গোত্রের কাছে সারাজীবন নত হয়ে থাকতে হবে। গোত্র নেতৃত্বের যুগে এই হীন মানসিকতা তাদের জন্য ছিল বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। বর্বরতার এই চরম মুহূর্তে দয়ার সাগর হযরত মুহাম্মদ (সা.) এসে কন্যা সন্তানকে ধ্বংসের অতল গহবর থেকে টেনে তুললেন এবং সম্মান ও মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন করে খোদায়ী নির্দেশ কামনা করলেন। ওহী নাজিল হল: তোমরা দারিদ্রের ভয়ে সন্তানদের হত্যা করো না। তোমাদের এবং তাহাদের আহার্য দিয়ে থাকি। জেনে রাখো যে, সন্তান হত্যা নিঃসন্দেহে একটি জঘন্য অপরাধ। কালাম পাকের এই নির্দেশ শুনে মুমিনগণ চমকে উঠলেন এবং কন্যা হত্যার নির্দয় অভ্যাস তারা চিরতরে বর্জন করলেন। নবী করিম (সা.) নিজেও বাণী প্রদান করলেন: “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম যার প্রথম সন্তান কন্যা।” তিনি আরো বললেন: যে ব্যক্তি দুটি কন্যা সন্তানকে লালন পালন করে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে, কিয়ামতের দিন আমি এবং সে হাতের দুটি আঙ্গুলির ন্যায় পাশাপাশি থাকব। তিনি আরো বললেন: ‘যদি কারো কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং সে তাদের প্রতিপালন করে তাহলে তারা তার জন্য দোযখের প্রতিবন্ধক হবে।” অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে: যার তিনটি কন্যা সন্তান থাকবে, সে জন্য সে ধৈর্য ধারণ করে এবং নিজের সামর্থ অনুযায়ী তাদের ভালো পোশাক পরতে দেয়, তবে তারা তার জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে: কন্যা সন্তানের জন্ম পিতামাতার জন্য লজ্জাকর নয় বরং কন্যার প্রতিপালন ও হক আদায় করার দ্বারা তাদের বেহেশত লাভ হতে পারে।
 
স্ত্রী হিসাবে নারীর অধিকার ও অবস্থান:- ইসলাম পূর্বযুগে নারীদের অবস্থা ছিল করুণ। তখন স্ত্রীদের সেবাদাসী মনে করা হত। স্বামীর কাজকর্ম ও সেবাযত্ন করাই ছিল তাদের পেশা। ভোগবিলাসের বস্তু ছাড়া নারীকে আর কিছুই মনে করা হতো না। স্বামী তার স্ত্রী প্রতি অহরহ পশুসুলভ আচরণ চালিয়ে যেতো। ফলে তাদের উভয়ের জীবনে নেমে আসত দূর্বিসহ যন্ত্রণা। ইসলাম সমস্ত সমস্যার মূলে কুঠারাগাত হেনে স্ত্রী বা নারী জাতিকে মর্যাদা ও সম্মানের মনিকোঠায় স্থান দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে: হুন্না লিবাসুন লাকুম, ও আনতুম লিবাসুন লাহুন্না। (তারা তোমাদের পরিচ্ছেদ. তোমরা তাদের পরিচ্ছদ।)
অনত্র এরশাদ হচ্ছে: স্ত্রীকে কষ্ট যন্ত্রণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখো না।”
“তোমাদের মধ্যে তারাই উৎকৃষ্ট ব্যক্তি যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে উৎকৃষ্ট এবং আপন পরিবার পরিজনের প্রতি স্নেহশীল।” ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) স্ত্রী ও নারীদের সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। তিনি বলেন: “পৃথিবীর বস্তুসমূহের মধ্যে নারী ও সুগন্ধি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং নামাজ আমার চোখের শীতলতা।” তিনি আরো বলেন: পৃথিবীর নেয়ামত সমূহের মধ্যে স্ত্রী হতে উৎকৃষ্ট নেয়ামত আর কিছু হতে পারে না।”
হযরত বিন ওমর বলেন: নবী করিম (সা.) যে পর্যন্ত জীবিত ছিলেন সে পর্যন্ত আমরা আমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতাম। যাতে আমাদের উপর কোন শাস্তিমূলক বিধান অবতীর্ন না হয়। নবী করিম (সা.) এর ইন্তেকালের পর আমরা প্রাণ খুলে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগলাম। অতএব বলা যেতে পারে, নারী জাতির মর্যাদা ও অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে ইসলাম পৃথিবীর সকল ধর্মের শীর্ষে রয়েছে।
মা হিসাবে নারীর অধিকার ও অবস্থান:- ইসলাম নারীদের মা হিসাবে যে অধিকার ও মর্যাদা দান করেছে পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম, অন্য কোন দল বা গোষ্ঠী তা দিতে পারে নি। রাসূলে করিম (সা.) এর আগমনের পূর্বে সমস্ত দুনিয়ার মানুষই পিতাকে মাতার চেয়ে বেশি সম্মানের পাত্র বলে মনে করত। এবং মাতার উপর পিতার প্রাধান্য দিত। কুরআনের আয়াত নাযিল হল: আমি মানুষকে তার পিতা মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু সে যেন ভুলে না যায় যে, তার মাতা কত কষ্টের পর কষ্ট করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছিল আর সুদীর্ঘ দু’বছর ধরে তাকে নিজের দেহ নিংড়ানো স্তন্য দান করেছিল।”
আর নবী করিম (সা.) বলেন: “ সন্তানের জান্নাত হল তার মায়ের পায়ের নীচে।” বিশ্ব দরদী মুক্তির কান্ডারী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন: আল্লাহ ও রাসূলের পরে সবচেয়ে বেশি অধিকার ও মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য মাতা।” একদা জনৈক সাহাবী রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল আমার নিকট থেকে সবচেয়ে বেশি সদ্ব্যবহার পাওয়ার হকদার কে? রাসূল (সা.) উত্তর দিলেন : তোমার মাতা। তিনি আবার বললেন: তারপর কে? রাসূল (সা.) উত্তরে বললেন : তোমার মাতা। তিনি আবার বললেন : তারপর কে? রাসূল (সা.) উত্তরে বললেন: তোমার মাতা। চতুর্থবার সাহাবী প্রশ্ন করলে উত্তরে বললেন: তোমার পিতা। অন্যত্র বর্ণিত হচ্ছে: ‘মাতার নাফরমানী আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য হারাম করে দিয়েছেন।’এতেই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম মা তথা নারী জাতিকে কত উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন।
 
নারীর শিক্ষার অধিকারঃ- মানব শিশু জন্মের পর থেকে প্রথমেই সে মায়ের মুখের ভাষা শেখে। মায়ের কথা বলার ধরণ, আচার-আচরণ, নৈতিকতা এমনকি তার মতই শিষ্টতা সম্পন্ন হয়। এজন্য মাকে হতে হবে সুশিক্ষায় শিক্ষিতা। যদি সে নিজে সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে সে অন্য একজনের সুশিক্ষার দায়িত্ব কিভাবে পালন করবে? এজন্য দ্বীন ও পার্থিব শিক্ষা লাভ করার জন্য তাকে শুধু অনুমতিই দেয়া হয় নি; বরং পুরুষের শিক্ষা-দীক্ষা যেমন প্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছে, তাদের শিক্ষা-দীক্ষাও তদ্রুপ মনে করা হয়েছে। নবী করি (সা.) বাণী প্রদান করেছেন: প্রত্যেক মুসলমান নর নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। নবী করিম (সা.) থেকে পুরুষগণ যেমন দ্বীনি ও নৈতিক শিক্ষা লাভ করত নারীগণও তদ্রুপ করত। নারীদের জন্য সময় নির্ধারিত করা হত এবং সেই সময়ে তারা নবী করিম (সা.) এর নিকট থেকে শিক্ষা লাভের জন্য উপস্থিত হত।মহানবী (সা.) তাঁর স্ত্রী হাফসা বিনতে উমরকে লিখন পদ্ধতি শিক্ষা দেয়ার জন্য শেফা বিনতে আবদুল্লাহকে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি কৃতদাসীদেরকেও শিক্ষার সুযোগ দিতে আদেশ করেছেন। রাসূল (সা.) মহিলাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা লাগবের জন্য মসজিদে আগমনের অনুমতি প্রদান করেছিলেন। তাছাড়া মহিলা সাহবীগণের যখন কোন সসস্যা সৃষ্টি হত, তখন তারা অবাধে রাসূল (সা.) এর সমানে উপস্থিত হয়ে তাঁর নিকট হতে অথবা তার স্ত্রীগনের মাধ্যমে সমাধান লাভ করতেন। তদুপরি রাসূল (সা.) পিতা ও স্বামীগণকে ও নির্দেশ প্রদান করেন যে, তারা তাদের কন্যা ও স্ত্রীদেরকে ধর্মের নির্দেশাবলী শিক্ষা দিবেন।
 
অর্থনৈতিক অধিকার ও অবস্থানঃ- অর্থনৈতিক দিক আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যেটা আসে সেটা হল উত্তরাধিকার আইন। ইসলাম পূর্ব যুগে নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির মালিক থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু ইসলাম তাকে দিয়েছে পূর্ণ অধিকার। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে: ‘পিতা মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে। সে পরিত্যক্ত সম্পত্তি পরিমানে অল্পই হোক অথবা বেশিই হোক। এ অংশ নির্ধারিত। আর সে নির্ধারিত অংশ হল দু’জন মহিলার অংশের সমান। বাহ্যিক দৃষ্টিতে উত্তরাধিকার প্রশ্নে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা রা করা হয় নি। পুরুষের তুলনায় নারীর আর্থিক সুবিধা খর্ব করা হয়েছে। ইসলামের গোটা পারিবারিক পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টি দিলে এই বৈষম্যের কারণ বোধগম্য হবে। ইসলাম নারীকে পুরুষের তুলনায় উত্তরাধিকারের অংশ অর্ধেক দিলেও দুই উপায়ে তা পুষিয়ে দিয়েছে। প্রথমত: স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত মোহরানার উপর সম্পূর্ণভাবে স্ত্রীরই অধিকার থাকবে। পিতা বা অন্য কোন অভিভাবক বা স্বামী তা আত্মসাৎ করতে পারবে না। মোহরানা থেকে নারীকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে কঠোর ভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তবে স্ত্রী স্বেচ্ছায় দান করলে স্বামী বা পিতা সেটা ভোগ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত: বিবাহের সময় নারীকে প্রদত্ত অলংকার, উপহার ইত্যাদির মালিক সেই-ই। তাছাড়া স্বামীর সম্পদ ও তো একজন স্ত্রীই তার সন্তান সন্ততি নিয়ে নিজের মত করে ভোগ করে। তদুপরি ইসলাম নারীর ভরণ পোষনের দায়িত্ব বিবাহের পূর্বে পুরুষ অভিভাবকের উপর এবং বিবাহের পর স্বামীর উপর ন্যস্ত করেছে। এই অবস্থায় নারী পুরুষের মধ্যে সমানাহারে উত্তরাধিকার বন্টন যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ -সম্পদের পরই আসে শ্রমের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদ। ইসলামী শরীয়তে সীমার মধ্যে থেকে অর্থনৈতিক ব্যাপারে শ্রম সাধনা করার অনুমতি রয়েছে নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই। অতএব একজন নারী ঠিক একজন নরের অনুরূপ সম্পদ অর্জন ও করতে পারে এবং তার অধিকারী ও হতে পারে। প্রয়োজনের তাগিদে সে যে কোন পেশা-ই অবলম্বন করতে পারে। আবার সে তার সম্পত্তি সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্বে রাখতে পারে এবং নিজের ইচ্ছানুযায়ী খরচ করতে পারে। সমাজে নারীর দাসত্বের প্রধান কারণই হচ্ছে তার আর্থিক দূর্গতি। ইসলাম ব্যতীত সকল আইন কানুন নারীকে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে দূর্বল করে রেখেছে। এমনকি ইউরোপে উনবিংশ শতাব্দিতেও নারীর বৈধ অধিকার স্বীকৃত ছিল না। কোন বিবাহিত রমনী স্বামীর অনুমতি ব্যতীত সম্পত্তির মালিক হতে পারত না। সম্পত্তি সংক্রাত বিষয়ে চুক্তি বা ক্রয় বিক্রয় করতে পারত না। অথচ ইসলামই দিয়েছে তার একমাত্র অর্থনৈতিক মুক্তির চূড়ান্ত অধিকার। যা অন্য কোন ধর্ম দেয়নি।
 
নারীর বিবাহের অধিকারঃ- বিবাহের ব্যাপারে ইসলাম মেয়েদের দিয়েছে পূর্ণ অধিকার। মেয়ে বয়োপ্রাপ্ত হলে পিতা মাতা তার বিয়ের ব্যবস্থা করবে ঠিকই, কিন্তু সেটা মেয়ের সম্মতি সাপেক্ষে অবশ্যই মেয়ের সম্মতি একান্ত প্রয়োজন। ইসলামী বিধান এই যে, নারী বিধবা হোক বা কুমারী হোক তার সম্মাত ব্যতীত তাকে বিয়ে দিতে পারে না।
খানসা বিনতে খাজাম আনসারিয়ার বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তার পিতা তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দিলে তিনি মহানবীর নিকট নালিশ করেন। মহানবী এ বিয়ে বাতিল করে দেন। একজন কুমারী মহানবীর দরবারে এসে নিবেদন করল, “আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন এতে আমি সন্তুষ্ট নই”। মহানবী তাকে বললেন, “তোমার ইচ্ছা হলে বিয়ে বহাল রাখতে পার অথবা বাতিল করেও দিতে পার।” এ থেকে বোঝা যায় মহানবী (সা.) শুধু নারী সম্পর্কে পুরুষের নয় বরং নারীরও মনোবৃত্তির পরিবর্তন করে দিয়েছেনএবং তাকে তার পূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যের অধিকার দিয়েছেন।
 
অভিন্ন আইনের অধিকারঃ- প্রাচীন ধর্মগুলো নারীকে নগন্য এবং কম মর্যাদা এবং পুরুষকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী মনে করে তাদের মর্যাদানুযায়ী পৃথক আইন রচনা করেছিলেন। কিন্তু ইসলামে নারী পুরুষের মর্যাদা সমান এবং তাদের জন্য অভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কুরআনে এরশাদ হয়েছে: পুরুষ যেমন কাজ করবে তেমনি ফল পাবে এবং নারী যেমন কাজ করবে ঠিক তেমনি তার ফল লাভ করবে। আরও এরশাদ হয়েছে: ‘নারী যদি এমন অপরাধ করে যা সাধারণ আইনে দন্ডনীয় তবে সে পুরুষের সমান শাস্তিই পাবে। বিচারের ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নি। যদি কোন মহিলা কোন পুরুষকে হত্যা করে তাহলে তার জন্য যা শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে তারজন্য ও একই শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। অর্থাৎ যে কোন অপরাধের জন্য নারী পুরুষ একই শাস্তি। ইসলাম জারীকৃত আইনের একটি ধারা হচ্ছে- “স্ত্রীলোকের হত্যাকারী কোন পুরুষ হলে শাস্তি স্বরুপ তাকে হত্যা করা হবে। অর্থাৎ সমস্ত ক্ষেত্রেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমান আইন প্রযোজ্য।
 
মত প্রকাশ ও পরামর্শের অধিকারঃ- ইসলামের পূর্ব যুগে মহিলাদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ও পরামর্শের কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু ইসলাম সমাজ জীবনের বিভিন্ন ব্যাপারে মেয়েদের অভিমত ও হৃদয়াবেগ প্রকাশের অবাধ অধিকার দিয়েছে। এটা তারা মৌখিকভাবে বা লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে। নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে এই মত প্রকাশের অধিকার তাদের রয়েছে। হযরত হাসান বসরী বলেছেন: নবী সা. মেয়েদের সাথেও পরামর্শ করতেন এবং কোন কোন সময় তাদের অভিমত গ্রহণ করতেন। মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে নারীদের মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির একটা শর্ত ছিল যে, এই বছর মুসলমানরা উমরা না করেই ফিরে যাবে। তাই রাসূল করিম (সা.) সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কে হুদায়বিয়াতেই ইহরাম খুলে ফেলা ও সঙ্গে করে নিয়ে আসা পশুগুলোকে জবাই করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সাহাবাগণ যেহেতু এই সন্ধির শর্ত দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন, সে কারণে তারা কেউ এই নির্দেশ পালনে কোন তৎপরতাই দেখালেন না। এরূপ অবস্থা দেখে রাসূল সা. হযরত উম্মে সালমা রা. এর নিকট দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি সাহাবাদের মনস্তত্ব ল্য করে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা সহকারে পরামর্শ দিলেন যে, আপনি এর পর আর কাউকে কিছু না বলে যা কিছু করার নিজেই অগ্রসর হয়ে করে ফেলুন। দেখবেন, সকলেই আপনার দেখাদেখি সব কাজই করবে। রাসূল সা. এই পরামর্শ সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং যখনই তিনি করণীয় সব কাজ করলেন সাহাবা কেরামরাও তার অনুসরণ শুরু করে দিলেন। এভাবে হযরত উম্মে সালমার রা. যথার্থ ও সুচিন্তিত পরামর্শ উপস্থিত অচলাবস্থা দুর করতে সক্ষম হল এবং বাস্তবে প্রমান করে দিল যে, মহিলাদেরও যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধি আছে এবং তাদের পরামর্শ জাতীয় জীবনে অনেক সমস্যারই সমাধান করতে সক্ষম।
 
ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ- প্রকৃত নারী স্বাধীনতা বলতে যা বুঝায়, তা ইসলামের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-ই নারীজাতিকে প্রদান করেছেন। মহানবী (সা) বলেন: “তাকওয়া ব্যতীত বংশগত ও প্রকৃতিগতভাবে এক শ্রেণীর উপর অপর শ্রেণীর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। পবিত্র কুরআন ন্যায় নিষ্ঠা, শান্তি সমৃদ্ধি এবং ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণে যে মানদন্ড পুরুষের জন্য নির্ধারিত করেছে, তা নারীর জন্যও নির্ধারিত করেছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমাণদার পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরস্কার দেব যা তারা করত। (সূরা নাহল, আয়াত: ৯৭) কুরআনের আলোকে রাসূল ((সা) পুরুষকে পরিবারের কর্তা এবং পরিবারের সদস্যদের ভরণ পোষণের জন্য দায়িত্বশীল নির্ধারণ করেছেন। আর নারীকে সমধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তা হল ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ ও সন্তানের লালন পালনের দায়িত্ব। মহানবী (সা) ইরশাদ করেন: পুরুষ তার পরিবার পরিজনের তত্ত্বাবধায়ক ও রক্ষক এবং তাদের সম্পর্কে তাকে জবাবদিহী করতে হবে। তেমনি নারী তার স্বামীর গৃহের রক্ষণাবেক্ষণাকরীণী এবং এই সম্পর্কে তাকে জবাবদিহি করতে হবে।” (বুখারী) প্রাচীন সামাজে নারীর জন্য শিক্ষার দ্বার রুদ্ধ ছিল। নবী করীম (সা) প্রথমেই এদিকে মনোযোগ দান করেন। তিনি ইরশাদ করেন, “ইলম অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নারী ও পুরুষের ওপর ফরজ।” (বুখারী) তাই আমাকে একজন নারী কর্মী হিসাবে ইসলামী জ্ঞান (ইলম) অর্জন করতে হবে। ইসলাম সম্পর্কে জরুরী ইলম অর্জন না করলে কোন লোকই ইসলাম পালন করতে পারে না। ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করা সম্ভব হয় না। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর প্রকৃত শিক্ষা এই যে, তা দ্বারা তাকে উৎকৃষ্ট স্ত্রী, উৎকৃষ্ট মাতা, এবং উৎকৃষ্ট গৃহিনীরূপে গড়ে তোলা হবে। যেহেতু আমার কর্মক্ষেত্র প্রধানত: গৃহ সেহেতু আমাকে এমন শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন যা এক্ষেত্রে আমাকে অধিকতর উপযোগী করে তুলতে পারে। উপরন্তু আমার জন্য ঐসকল জ্ঞানবিদ্যারও প্রয়োজন যা মানুষকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলতে, আমার চরিত্র গঠন করতে, দৃষ্টি ভঙ্গি প্রশস্ত করতে এবং আমাকে আমার অবস্থানে দৃঢ় আসন গড়ে নিতে সহায়তা করে। এই ধরনের শিক্ষা দীক্ষা প্রত্যেক নারীর জন্য অপরিহার্য। অতঃপর কোন নারী যদি অসাধারণ প্রজ্ঞা ও মানসিক যোগ্যতার অধিকারিণী হন এবং এই সকল শিক্ষা দীক্ষার পরও অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে চান, তাহলে ইসলাম তার পথে প্রতিবন্ধক হবে না। কিন্তু শর্ত এই যে, সে যেন শরীয়ত নির্ধারিত সীমা অতিক্রম না করে। এভাবে নিজেকে একজন বোন, মেয়ে, মা ও স্ত্রী হিসেবে সকল ক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে অবধান রাখতে হবে। যাতে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আদর্শ সমাজের সকল ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করতে কোন প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয়।
 
উপসংহারঃ- ইসলামই নারী সমাজকে এত উচ্চে স্থান দিয়েছে যে, পৃথিবীর অন্য কোন সমাজে তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। একজন নারী পার্থিব জীবনে, দ্বীনের ব্যাপারে, বৈষয়িক, আধ্যাত্মিকদিক দিয়ে সম্মানের ও উন্নতির এমন উচ্চ শিখরে আরোহন করতে পারে যেখানে একজন পুরুষ পারে। ইসলাম নারীদেরকে যেভাবে স্বাধীনতা দিয়েছে অন্য কোন ধর্ম তা দেয় নি। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। ইসলাম নির্দেশিত এই জীবন বিধানে নারীর অধিকার কতটুকু সার্থকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে সেটাই বিবেচ্য। পুরুষ আজ ইসলামের বিধান ভুলে নিজের স্বার্থে নারীকে ব্যবহার করছে। আজ একবিংশ শতাব্দীর উত্তরাধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে সেই জাহেলিয়াতের যুগের মত নারীর উপর চালাচ্ছে অকথ্য নির্যাতন। পুড়িয়ে মারা হচ্ছে নুরজাহানের মত মেয়েদের, ধর্ষিত হচ্ছে ইয়াসমিন, সীমাসহ নাম না জানা হাজারো মেয়ে, এবং আ্যসিড দিয়ে ঝলসানো হচ্ছে বিয়ের পিড়িতে বসা শিখার মত কিশোরী মেয়েকে অহরহ।
ধর্মে নির্দেশিত পিতার দায়িত্ব-কর্তব্য, ভাইয়ের কর্তব্য, স্বামীর কর্তব্য ভুলে গিয়ে আপন কন্যা, বোন ও স্ত্রীকে পণ্য হিসেবে তুলে ধরছে আপন স্বার্থ চরিতার্থ করতে। নারীকণ্ঠ একদিকে যেমন নারী স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সোচ্চার হচ্ছে- অন্যদিকে তাদের উপর অত্যাচারের মাত্রা দিন কে দিন বাড়ছে। সভা, সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে বা মিছিলে শ্লোগান দিয়ে নয়- আপন অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়ে নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের কাছে মা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, কন্যা হিসেবে উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মানটুকু আদায় করতে পারলেই আমাদের এই নারী আন্দোলনের প্রচেষ্টা সফল হবে। এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন ইসলামের প্রথম নির্দেশ- ‘ইকরা’ অর্থাৎ ‘পড়’। পড়ার মাধ্যমে, শিক্ষার মাধ্যমে, প্রকৃত জ্ঞান লাভের মাধ্যমে আমরা আমাদের অধিকার ও অবস্থান সম্পর্কে যদি সচেতন হই তাহলে এই সুন্দর পৃথিবীতে আরো সুন্দর ভাবে বাঁচতে পারব নিজেরা এবং বাঁচাতে পারব অন্যদেরকে এবং এই সুন্দর পৃথিবীকে আগামীর জন্য আরো সুন্দর ভাবে গড়ে যেতে পারব বলে আশা রাখি ইনশাআল্লাহ। তাই আসুন, হযরত মহানবী (সা.) নারী সমাজের জন্য যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা আমাদের ব্যাক্তিজীবন থেকে সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত মেনে চলে জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করি।
 
by nur husain,italy
Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: