যিকির

যিকির শব্দের অর্থ আল্লাহর স্মরন। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে যে কাজের দ্বারা সওয়াব হয় তাহাই জিকির। কারণ প্রতিটি সওয়াবের মুহুর্তেই আল্লাহর স্বরন হয়। যিকির শব্দের অর্থ যেহেতু স্মরণ করা, উচ্চারণ করা নয় তাই আল্লাহর জিকির ঠিকভাবে করতে হলে উপরোক্ত যে কোন একটি বাক্যের দ্বারা মনে মনে উচ্চারণ করতে হবে। হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রঃ) এর মতে “মুমিনের এক মুহুর্তের জন্য আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরুপ হওয়া বেআদবীর শামিল।”

 

রসুল পাক (সঃ) কে একবার জিজ্ঞাসা করা হলো কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে কোন বান্দা সবচেয়ে শ্রেষ্ট ও উচু মর্যাদার আধিকারী হবে ? জবাবে রসুলে পাক বললেন আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণকারী নারী ও পুরুষ গন। তখন আবার প্রশ্ন করা হলো আল্লাহর রাস্তায় জেহাদকারী অপেক্ষাও কি? জবাবে রসুল পাক (সঃ) বললেন হ্যা সে যদি তার তরবারী দ্বারা কাফের ও মুশরেকদেরকে এমন ভাবে কাটে যে, তার তরবারী ভেঙ্গে যায় আর সে নিজে রক্তে রক্তাক্ত হয়ে যায়। তবওু তার চেয়ে আল্লাহর যিকিরকারী মর্যাদার দিক দিয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ। (আহমদ, তিরমিজি, বাইহাকী,মিশকত)।

রসুল পাক (সঃ) বলছেন : আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি দ্বাতা আল্লাহর যিকিরের চেয়ে আর কোন জিনিস নাই। (বইহাকী, মিশকাত)

সৃষ্টি কর্তা মহান আল্লাহ তায়ালার আদেশ নিষেধ বা বেহেস্তের আনন্দ ও দোযখের শাস্থির কথা মনে থাকে না বা বিশ্বাস করে না। তার সামনে যতই হাদিস বা কোরআনের আয়াত বা কোরআনের কথা বলা হোক না কেন কোন কথাই তার মনে দাগ কাটে না। অর্ধাৎ ধর্মের কথা শুনতে তার খারাপ লাগে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই মনের অসুস্থতা ও জং বা ময়লা কিভাবে দুর করা যায় এবং এগুলো আমদের ক্বলব বা মন থেকে দুর করতে পারলে কি উপকার হবে। রাসুল পাক (সঃ) বলেন : “প্রতিটি বস্তু পরিস্কার করার জন্য একটি যন্ত্র বা রেত থাকে। তদ্রুপ মনের পরিচ্ছন্নতা আনার যন্ত্র হচ্ছে আল্লাহর জিকির বা স্বরণ”।

রাসুল পাক (সঃ) বলেন : “হে আল্লাহ আপনার জিকিরের দ্বারা আমাদের ক্বলবের তালা গুলো খুলে দিন।”

রাসুল পাক (সাঃ) আরো বলেন : “মানুষ যখন কোন খারাপ কাজ বা গুনাহ করে তখন তার ক্বলবের মধ্যে কালো দাগ পড়ে যায়। তওবা ও এস্তে-গফার করে নেয় তাহলে তার ক্বলব ছাফ হয়ে যায় আর যদি গুনাহ বাড়তে থাকে তাহলে দাগও বাড়তে থাকে ও অবশেষে এটা ক্বলবকে ঘিরে ফেলে” (তিরমিজি শরীফ)।

রাসুল পাক (সঃ) আরে বলেন : “নিশ্চয়ই ক্বলব সমুহে মরিচা পড়ে। যেমন ভাবে লোহার মধ্যে পানি লাগলে মরিচা পড়ে। তখন সাহাবায়ে কেরাম (রঃ) বললেন হে আল্লাহর রসুল (সাঃ) এটা পরিস্কার করার উপায় কি? জবাবে রাসুল পাক (সঃ) বললেন মৃত্যুকে খুব বেশী বেশী স্মরণ করা আর কোরান তেলওয়াত করা”।

রসুল পাক (সঃ) বলেছেন আমি কি তমাদিগকে এমন একটা আমলের কথা বলবোনা যা সকল আমল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তোমাদের মর্যাদাকে সবচেয়ে উচুকারী, সণ্বর্ ও রুপাদান করার চাইতেও শ্রেষ্ঠ এবং জিহাদে শত্রুদের সম্মুখীন হওয়া যে,তোমরা তাদেরকে মারবে আর তারা তোমাদের মারবে এভাবে জেহাদ করার চাইতেও উত্তম? তখন সাহাবা (সঃ) গন উত্তরে বললেন হ্যা অবশ্যই বলুন। তখন রাসুল (সঃ) বললেন : তা হলো আল্লাহর জিকির (আহমদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, ইবনে আবিদ, দুনিয়া, হাকেম, বাইহাকী, জামে সগীর, মিশকাত শরীফ।)

হযরত মায়াজ ইবনে আনাস (সঃ) থেকে বর্ণিত আছে জনৈক ব্যক্তি রসুল পাক (সঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন মুজাহিদ গণের মাঝে সর্বাধিক প্রতিদান ও সওয়াবের অধিকারী কোন ব্যক্তি হবে ? রসুল পাক (সঃ) বললেন : ‘‘যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে ম্মরণ করে অথার্ৎ জিকির করে। অতপর জিজ্ঞাসা করা হলো রোজাদার গণের মধ্যে সর্বোচ্চ সওয়াবের অধিকারী কে হবে? তিনি (সঃ) বললেন যে রোজাদার আল্লাহর জিকির সবচেয়ে বেশী করবে। এরুপ ভাবে নামাজ, যাকাত, হজ্ব, সদকা প্রভৃতি সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করলো। তিনি প্রতিবার একই উত্তর দিলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকির সবচেয়ে বেশী করবে সেই সর্বোচ্চ প্রতিদান লাভ করবে।’’

যাবতীয় ইবাদত সমুহের মধ্যে জিকির বা আল্লাহর স্মরনই একমাএ একটি এবাদৎ যা কমকষ্টে সহজ পব্দতিতে করা যায় এবং অল্প আমলে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়। অজু অবস্থায়, অজু ছাড়া, বসা, দাড়ানো এবং শোয়া অবস্থায় এই এবাদৎ করতে কোন বাধা নেই।

পবিত্র কোরঅনে সুরা বাকারায় আল্লাহ পাক বলেন :‘‘তোমরা আমাকে স্বরন করো আমিও তোমাদেরকে স্বরন করবো।’’ -১৫২

বান্দা যদি আল্লাহকে স্বরন করে তবে আল্লাহও বান্দাকে স্বরন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হযরত সাবেত বুনানী (রাঃ) বলেন : ‘‘আল্লাহ পাক কখন আমাকে স্বরন করেন তা আমি জানি।’’

লোকেরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : ‘‘আমি যখন আল্লাহকে স্মরন করি ঠিক তখনই তিনি আমাকে স্মরন করেন।’’

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন : ‘‘আল্লাহপাক জিকির ব্যতিত কোন ফরজই আরোপ করেননি যার পরিসীমা বা পরিধি নির্ধারিত নেই, নামাজ দিনে পাঁচবার রমজানের রোজা নিদৃষ্ট সময়ের জন্যে, যাকাতও বৎসরে একবার দিলেই হয় কিন্তু আল্লাহর জিকির বা স্ম্বরন এমন একটা এবাদত যার কোন সীমা সংখ্যা নির্ধারিত নেই, বিশেষ কোন সময়কালও নির্ধারিত নেই অথবা এর জন্য নো, বসা বা শায়িত অবস্থায় থাকারও কোন কথা নেই। এমন কি অজু ও পবিত্র অবস্থায় থাকারও কোন শর্ত নেই। সফরে থাকুক বা বাড়িতে থাকুক, সুস্থ থাকুক বা অসুস্হ্থ থাকুক, জলভাগ কিংবা স্থলভাগ, রাত হোক বা দিন সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণের হুকুম রয়েছে। এজন্য জিকির বা আল্লাহর স্মরণ বর্জনকারীর কোন কৈফিয়ত গ্রহন যোগ্য হবে না। যদি না সে অনুভূতি বিহিন ও বেহুশ হয়ে পড়ে।’’

পবিত্র কোরআনের তাগিদে : “হে ঈমানদার গণ, তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর”(সুরা আহযাব – ৪১)

তারাই জ্ঞানী ব্যক্তি যারা দাড়ানো বসা এবং শোয়া অবস্থায় তথা সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে (সুরা আল ইমরান – ১৯১)।

“অতঃপর তোমরা যখন নামায সম্পন্ন কর তখন দন্ডায়ামান, উপবিষ্ঠ ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ কর” (সুরা নিসা – ১৪২)।

“তুমি স্বীয় অন্তকরণে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ কর বিনয়ের সাথে এবং ভয়ের সাথে আরও স্মরণ কর প্রত্যুসে ও সন্ধ্যায় উচ্চ স্বরে ব্যতিরেকে নিম্ম স্বরে। আর গাফেলদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না” (সুরা আরাফু- ২০৫)।

“আল্লাহর স্মরণই (জিকির) সবচেয়ে বড়” (সুরা আনকাবুত – ৪৫)।

“আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণকারী এবং স্মরণ কারীনি, আল্লাহ তাদের জন্য মাগফেরাত ও প্রতিদানের ব্যবস্থা রেখেছেন” (সুরা আহযাব- ৩৫)।

“সকাল সন্ধ্যা তোমরা রবের স্মারণ কর” (সুরা দাহার -২৫)।

হযরত মুসা (আঃ) এর উদ্দেশ্যে আল্লাহপাক বলেছেন : “(হে মুসা) তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনাবলী সহ যাও এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করো না।” (সুরা তোয়াহা -৪২)।

হযরত মুসা (আঃ) ও আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে একবার বলেছেন : “তাকে (আমার ভাইকে) আমার কাজে অংশীদার করুন। যাতে আমরা বেশী করে আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করতে পারি এবং বেশী পরিমানে আপনাকে স্মরণ করতে পারি” (সুরা তোয়াহা ৩২-৩৪)।

জিকির বা আল্লাহর স্মরণ হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে অল্প আমলে অধিক সওয়াব পাওয়ার মাধ্যম। অপরদিকে জিকির হচ্ছে যাবতীয় ইবাদতের দেহ। পবিত্র কালাম পাকে এরশাদ হচ্ছে : “তোমরা আমার স্মরণের উদ্দেশ্যে নামাজ কায়েম কর”।

হযরত মুয়াজ ইবণে যাবাল (রঃ) বলেন : ‘‘বেহেশতীরা বেহেস্তে অবস্থান কালে কোন বিষয়ই আফসোস করবেনা, শুধুমাত্র পৃথিবীতে অবস্থান কালে যে সময়টুকু আল্লাহর জিকির করে নাই সে সময় টুকুর জন্যই আফসোস করবে।’’

রসুলপাক (সঃ) বলেন : ‘‘যে ব্যক্তি জান্নাতের বাগিচায় পায়চারী করতে চায়, সে যেন অধিক পরিমানে আলা্লহর স্মরণ করে।

হযরত মুয়াজ ইবণে যাবাল (রঃ) বলেন : ‘‘বেহেশতীরা বেহেস্তে অবস্থান কালে কোন বিষয়ই আফসোস করবেনা, শুধুমাত্র পৃথিবীতে অবস্থান কালে যে সময়টুকু আল্লাহর জিকির করে নাই সে সময় টুকুর জন্যই আফসোস করবে।’’

হাদিসে কুদসিতে আছে: আল্লাহপাক বলেন : ‘‘যদি আমার বান্দা আমাকে অন্তরে স্মরণ করে, আমিও তাকে স্মরণ করি। অনুরুপ ভাবে বান্দা যখন আমার দিকে এক বিঘৎ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে একহাত অগ্রসর হই। বান্দা যদি আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয় আমি তার উভয় বাহু বিস্তৃত পরিমান তার দিকে অগ্রসর হই। যদি সে আমার দিকে হেটে অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দৌড়িয়ে যাই।’’

হযরত আবু হুরাইরা (রঃ) বলেন : ‘‘দুনিয়ার যে ঘর গুলোতে আল্লাহর জিকির হতে থাকে সে ঘর গুলো উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় চমকাতে থাকে। ফেরেস্তারা আসমান থেকে তা অবলোকন করতে থাকেন।’’

রসুল পাক (সঃ) ইরশাদ করেন : ‘‘কোন মানব দল কোথাও বসে আল্লাহর জিকির করলে ফেরেস্তারা তাদের ঘিরে নেয় এবং তাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়।’’

অধিকন্তু আল্লাহ তায়ালা তার ফেরেস্তাদের নিকটে তাদের স্মরণ করেন। অযুতে বা বিনা অযুতে উঠতে বসতে চলতে ফিরতে সব সময় আল্লাহর জিকির করা যায়। এর জন্য মানুষের কোন পরিশ্রমই করা লাগেনা। কোন অবসরের প্রয়োজন হয়না। কিন্তু এর সুফল এবং ফলশ্রুতি এত ব্যাপক যে আল্লহর স্মরণের মাধ্যমে পার্থিব কাজ কমর্ও ইবাদতে রুপান্তরিত হয়। আহার গ্রহণের পূর্ববর্তী দোয়া, বাড়িতে ঢোকার ও বাড়ি থেকে বের হওয়ার দোয়া, কোন কাজের সূচনা ও পরিসমাপ্তির দোয়া প্রভৃতি দোয়ার তাৎপর্য্য ও সারমর্ম এই যে মোসলমান যেন কোন সময়ে আল্লাহর স্মরণে অমনোযোগী ও গাফেল হয়ে কোন কাজ না করে। কোন বিশেষ সময়েই নয় বরং সর্বক্ষন আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট এবং তার কন্ঠ আল্লাহর স্মরণে সিক্ত থাকলেই এর মাধ্যমে ইবাদত এবং অন্যান্য দ্বীনি কাজের প্রান প্রতিষ্ঠা হয়। মানুষের মধ্যে যখন এই অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন তার জীবনের ইবাদৎ এবং দ্বীনি কাজ ঠিক তেমনিভাবে বিকাশে লাভ করে যেমন একটি চারা গাছকে তার প্রকৃতির অনুকুল পরিবেশ ও আবহাওয়ায় রোপন করা হয়।

পক্ষান্তরে যে জীবন আল্লহর স্মরণে শূন্য থাকে, সেখানে বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ সুযোগ অনুষ্ঠিত ইবাদত এমন একটি চারা গাছের ন্যায় যাকে তার প্রকৃতির নিছক বাগানের মালিকের বিশেষ তত্ত্বাবাধানে বেঁচে থাকে। একজন প্রকৃত মুসলমান কখনই আল্লাহর স্মরণবিহীন থাকতে পারে না। প্রাত্যাহিক ঘুমাতে যাওয়ার সময়ের দোয়া ঘুম থেকে উঠে পড়ার দোয়া, অযু করার পূর্বের দোয়া, গোসলের দোয়া, দৈনন্দিন প্রতিটি কাজের শুরুতে দোয়া পড়া। এই ভাবে একজন মুমিন ঘুম থেকে জেগে আবার ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহুতর্ পর্যন্ত আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসুল পাক (সাঃ) এর প্রদর্শিত আমল সমূহ পর্যালোচনা করলে দিনে রাতে ২৪ ঘন্টাই আল্লাহর জিকির অথার্ৎ স্মরণ করতে পারে। বাস্তবে কোন অবৈধ পথ অবলম্বন করতে গেলেই আল্লহর স্মরণ হবে এবং অন্যায় ও অবৈধ কাজ করা থেকে বিরত থাকবে।
সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে আমাদের ক্বলব বা মন পরিষ্কার ও সুস্থ হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেন :

” একমাত্র আল্লাহর যিকিরেই (মানুষের) ক্বলব(মন) প্রশান্তি লাভ করে।”

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: