লাইলাতুল মেরাজের বিভিন্ন দিক

মেরাজ শব্দের অর্থ ঊর্ধ্বগমন, ঊর্ধে আরোহণ, আরোহণের সিঁড়ি। যেহেতু হজরত মুহাম্মদ (স.) তার এক মহাকাশ ভ্রমণ সম্পর্কে এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এজন্য তার এই ভ্রমণকে মেরাজ বলা হয়। এ ভ্রমণ যেহেতু রাতের পর রাত অব্যাহত ছিল, সেজন্য একে ইসরাও বলা হয়। কুরআনুল কারীমে এই শব্দটিই ব্যবহূত হয়েছে। নবুয়তের একাদশ ও দ্বাদশ বছরের মধ্যবর্তী সময়ে, হিজরতের প্রায় বছর দেড়েক আগে, রজব মাসে রাসূল (স.)-এর মেরাজ সংঘটিত হয়। মহানবীর জীবনে সংঘটিত আশ্চর্যজনক বিষয়াবলির মধ্যে মেরাজ অন্যতম। মহান আল্লাহ তার বন্ধুকে মক্কার মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসা এবং তথা হতে ঊর্ধ্বজগত্ পর্যন্ত স্বশরীরে আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাদি দেখাবার জন্য ভ্রমণ করিয়েছিলেন। এই বিস্ময়কর ঘটনাটি পবিত্র কুরআনের সূরা বনী ইসরাঈল ও সূরা নাজমে উল্লেখ রয়েছে এবং অসংখ্য হাদিসে মেরাজের ঘটনা বর্ণিত আছে।

একজন মুমিনকে যেসব অদৃশ্য সত্যের প্রতি ঈমান আনতে হয়, মেরাজে নিয়ে হজরত মুহাম্মদ (স.)-কে তা স্বচক্ষে দেখানো হয়েছে। তবে ঠিক কোন মাস বা তারিখে মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল তা কোনো হাদিসে বর্ণিত হয়নি। রাসূলুল্লাহ (স.) একটি হাদিসেও মেরাজের তারিখ বর্ণনা করেননি। সাহাবীগণও (স.)কে মেরাজের তারিখ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেননি। এর প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেননি। পরবর্তী যুগের তাবেঈগণও মিরাজের তারিখ সম্পর্কে কোনো আলোচনা করেননি। মেরাজের রাতের শিক্ষাগুলো ছিল তাদের কাছে মুখ্য। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ ও ঐতিহাসিকগণ যখন এর তারিখ নিয়ে আলোচনা করে তারা এর তারিখের বিষয়ে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি। এ বিষয়ে প্রায় ২০টি মতো রয়েছে। তার কারণ হলো, এ রাতটি সাহাবীদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ রাত্রি হিসেবে পরিচিত ছিল না। তবে ২৭ তারিখের যে মতটি আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে সেটি তাবেঈ ও পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণের অনেকগুলো মতের থেকে একটি প্রসিদ্ধ মত।

মহানবী (স.) মেরাজ থেকে ফেরার সময় আল্লাহতায়ালা তার একনিষ্ঠ ইবাদত ও আনুগত্য হিসেবে মু’মিনদের মেরাজস্বরূপ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ প্রদান করেন। আর পরবর্তী সময়ে তথা মদিনায় হিজরতের পর ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করতে গেলে তা পরিচালনার জন্য যে নীতিমালা প্রয়োজন হবে তার প্রতি নির্দেশ করত আল্লাহ নীতিমালা পেশ করেন। সেই মৌলিক নীতিগুলোর ওপর সমষ্টিগতভাবে মানবজীবনের মূলভিত্তি গড়ে তোলাই ইসলামের আসল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। (সূরা বনী ইসরাঈল : ২৩-২৭)। কুরআনের সে নীতিমালা নিম্নরূপ:

০১. এক আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করা। ০২. পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করা। ০৩. নিকট আত্মীয় ও অভাবীদের অধিকার দেয়া। ০৪. অপব্যয় থেকে বিরত থাকা। ০৫. দুস্থ-অভাবীদের সাথে সুন্দর আচরণ করা। ০৬. অর্থ ব্যয়ে ভারসাম্যতা রক্ষা করা। ০৭. দারিদ্র্য তার ভয়ে সন্তান হত্যা করা যাবে না। ০৮. যেনা ব্যভিচারের নিকটে ও যাওয়া যাবে না। ০৯. প্রাণ হত্যা না করা। ১০. এতিমের ধনমাল ভক্ষণ না করা। ১১. অঙ্গীকার বা আমানতপূর্ণ করা। ১২. মাপে ও জনে সঠিক দেয়া। ১৩. ভিত্তিহীন ধারণার পিছনে না পড়া। ১৪. যমিনে বাহাদুরী করে চলা যাবে না।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়া মেরাজ উপলক্ষে আল্লাহর নিকট থেকে আরও দুটি উপহার পাওয়া গেল। একটি হচ্ছে সূরা বা কারার শেষ আয়াত সমষ্টি, যাতে ইসলামের মৌল আকিদাগুলো এবং ঈমানের পূর্ণতার বিষয় বিবৃত করার পর এই মর্মে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, মুসিবতের দিন এখন সমাপ্ত-প্রায়। দ্বিতীয় হচ্ছে এই সুসংবাদ যে, উম্মতে মুহাম্মদীর ভিতর যারা অন্তত শিরক থেকে বেঁচে থাকবে, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। (রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন)।

উল্লেখ্য যে, রজব মাসে আইয়ামে বীজের রোজা ছাড়া অন্য কোনো রোজার কথা নবী করীম (স.) বলেননি। পাশাপাশি তাহাজ্জুদ নামাজ ছাড়া আর কোনো নফল নামাজের কথাও বলেননি। হাদিস শরীফে শবেবরাত ও শবে মেরাজের নামাজ বলে কোনো নামাজের কথা আসেনি। মেরাজের রাত্রিতে বিশেষ নফল নামাজ আদায়ের ফজিলতবিষয়ক সকল হাদিস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। (হাদিসের নামে জালিয়াতি: প্রচলিত মিথ্যা হাদিস ও ভিত্তিহীন কথা, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর)। রাসূলুল্লাহ (স.) শুধু বিশেষ কোনো রাত্রিতে নামাজ পড়তেন না এবং বিশেষ কোন রাত্রিতে তা পড়ার জন্য তিনি কাউকে বলেননি। তবে রামাদান মাসে কিয়ামুললাইলের কথা এসেছে দুইভাবে। প্রথমত সাধারণভাবে রামাদানে কিয়ামুল লাইলের কথা এসেছে। দ্বিতীয়ত লাইলাতুল কাদরে কিয়ামুল লাইলের কথা এসেছে। কিন্তু অন্য কোনো বিশেষ রাত্রির বিশেষ কিয়ামের কথা কোনো হাদিসে আসেনি। এমনকি কদরের রাতে যে কিয়ামের কথা বলা হয়েছে. তার নামও কিন্তু কদরের রাতের নামাজ নয়। আর শবে মেরাজ ও শবে বরাতের নামাজের কথা তো বলাই বাহুল্য।

আমাদের দেশের কোনো কোনো এলাকার মসজিদে এই দুই রাত্রিতে জামাতের সাথে ১২ রাকাত নামাজ আদায় করা হয় এবং এই নামাজ শেষে আবার রামাদানের মতো বিতরের নামাজকে ও জামাতের সাথে আদায় করা হয়। রজব মাসের কোনো রাতের বিশেষ ফজিলতের কোনো বর্ণনা বা মেরাজের রাতের ফজিলত সম্পর্কে যে কয়টি হাদিস আমাদের সমাজে চালু আছে তার প্রায় সবই মুহাদ্দিসগণের বিচারে জাল ও বানোয়াট। বিশুদ্ধ হাদিসগ্রন্থে পাওয়া না গেলেও কয়েকজন মুহাদ্দিস দুর্বল সনদে রজবের প্রথম রাতে দুআকবুল হওয়া সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। (মুসান্নাফু আব্দুর রাজ্জাক, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা. ৩১৭)। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তকে সেই দুর্বল হাদিসের ফজিলতের বর্ণনা বিদ্যমান। লাইলাতুল মেরাজের রোজাও বিশেষ ইবাদাত সেই বর্ণনারই অংশ মাত্র। (বিদআতের বেড়াজালে ইবাদাত)। মেরাজের রাত নিয়ে এরূপ বাড়াবাড়ি এবং বিশেষ বিশেষ ইবাদতের প্রচলন নিঃসন্দেহে দীনের মধ্যে নতুনত্ব আরোপ তথা বিদআত। (বিদআতের পরিচয় ও পরিণাম, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার)। সহীহ হাদিসের ভিত্তিতে আমল করা সকল মুসলিমের কর্তব্য। আল্লাহ আমাদের সঠিকভাবে কুরআন-হাদিস বোঝার তাওফিক দান করুন। আমীন।

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: