সম্পদশালী হওয়া মানেই ধনী হওয়া নয়

সকল প্রশংসা আল্লাহ তালার জন্য

গ্রাম থেকে এক ভিখারী এসেছেন রাজার সঙ্গে দেখা করতে। রাত হয়ে যাওয়ায় তিনি কোথাও আশ্রয় না পেয়ে রাজমহলের পাশের মসজিদে শুয়ে থাকলেন সকাল হওয়ার অপেক্ষায়।

রাতের শেষ প্রহরে তিনি কান্নাকাটি আর আহাজারির শব্দ শুনে মসজিদের কোণায় গিয়ে দেখেন কেউ একজন দু’হাত তুলে বলছেন, হে আল্লাহ! আমাকে তুমি আরও দাও, আমার ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দাও, আমার বয়সকে আরও দীর্ঘ করে দাও, আমার রাজত্বের সীমানা আরও ছড়িয়ে দাও, আমার শত্র“দের ধ্বংস করে দাও..ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভিখারী লোকটি অনেকক্ষণ ধরে শুনতে থাকলেন লোকটির আশা আর চাওয়ার দীর্ঘ তালিকা। বুঝতে বাকি রইল না তার- এ লোকটিই এদেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজা। তিনি গালের নিচে হাত দিয়ে ভাবতে থাকল, হায় আল্লাহ! এ রাজা তো দেখি আমরা চেয়ে বড় ফকির। আমার চেয়ে আরও বেশি লোভী। তিনি যখন এত বড় ফকির, আমার মতো ভিখারীকে তিনি আর কিইবা দিতে পারেন?

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঝুলিটি কাঁধে ঝুলিয়ে রওয়ানা হলেন নিজের গ্রামের পথে। প্রহরী জিজ্ঞেস করলেন, কিহে! তুমি না কাল এসে আজ দেখা করার জন্য নাম লেখালে, চলে যাচ্ছো কেন?

হাসতে হাসতে তার জবাব, উনি আর আমি একই, ভিখারী। তার কাছে হাত পেতে আর কী পাব, তার চেয়ে বরং ভাল- উপরওয়ালার কাছেই হাত পাতি।
তাও তো ভাল, রাজা হাত পেতেছেন আল্লাহর কাছে। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এ প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের দেশের সাধারণ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার থেকে নিয়ে এমপি মন্ত্রী- পৃথিবীর যত রাজা মহারাজা- কোটিপতি কিংবা বিশ্বের শীর্ষ ধনী- সবার মনে এক বাসনা- আহা! আমি যদি আরও একটু বেশি পেতাম। আমার কত অভাব, কত কিছু প্রয়োজন- এখনও কত গরীব আমি!

চৌদ্দশ’ বছর আগে এজন্যই আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আদম সন্তানকে যদি দু’টি স্বর্ণভরা প্রান্তর দিয়ে দেওয়া হয়, তবু সে আরও একটি প্রান্তরের জন্য লালায়িত হয়ে বসে থাকবে। কবরের মাটি ছাড়া আর কিছুই তার পেট ভরাতে পারবে না।’ (তিরমিযী)

আমাদের চারপাশে কত মহাজন কত বেপারী কোটি কোটি টাকার মালিক! তবুও তাদের খায়েশ মেটেনা, সম্পদের লোভ তাদের দিনদিন আরও বাড়ছে। প্রতিটি সূর্যোদয় যেন তাদের জন্য নতুন নতুন ফন্দি নিয়ে হাজির হয়।

আর এ লালসা মেটাতে গিয়ে তারা কত নিরীহ মানুষের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, ছল চাতুরি আর প্রতারণা করে কামিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা- এর কি কোনো হিসেব আছে? সৃষ্টির সূচনার পর থেকে টাকা পয়সা উপার্জনের কত পথ ও পদ্ধতি যে আবিষ্কৃত হয়েছে- এর কোনো অভিধান নেই।

কিন্তু এত প্রাচুর্য কিংবা সম্পদশালী হওয়ার সব গৌরব ম্লান হয়ে যায় তাদের মানসিক দৈন্যতা ও সংকীর্ণতার কাছে। আসলে সম্পদ কম না বেশি- এ দিয়েই কি ধনী-গরিব মাপা যায়? আল্লাহর রাসুল (সা.) এ বিষয়টিকে মনে করিয়ে দিয়ে জানিয়েছেন, ধন-সম্পদের প্রাচুর্য মানেই ধনী হওয়া নয়, আসল ধনী হওয়া হচ্ছে মনের ব্যাপার। (বুখারী ও মুসলিম)

আর তাই মানসিক দিক দিয়ে যিনি যতবেশি উদার ও পরিস্কার এবং অন্যের সম্পদের মুখাপেক্ষি নন- তিনি ততবড় ধনী ও সম্মানিত।

ইমাম কুরতুবী বলেছেন, নির্লোভ হৃদয়ের ফকির এমন ধনীর চেয়েও বেশি সম্মানিত যিনি সবসময় সম্পদের জন্য লালায়িত হয়ে নিজেকে অন্যের কাছে হেয় করে রাখেন। অনেক সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও তিনি মানুষের কাছে তুচ্ছ ও ঘৃণিত।

রাসুল (সা.) এর কাছে একজন সাহাবী এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে এমন একটি কাজ শিখিয়ে দিন যা করলে আল্লাহ পাকও আমাকে ভালবাসবেন এবং মানুষও আমাকে পছন্দ করবে। রাসুল তাকে বললেন, দুনিয়ার প্রতি লোভ করো না, এতে আল্লাহ পাক তোমাকে ভালবাসবেন, আর মানুষের সম্পদ থেকে নির্লোভ থেকো, মানুষও তোমাকে ভালবাসবে।

একটু ভাবুন তো, আমরা যদি নিজের চাকরি ও জীবনযাপনে যেটুকু আল্লাহ পাক দিয়েছেন, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি এবং অন্যের সম্পদ থেকে চোখ ও লোভকে ফিরিয়ে রাখি, মানুষের কাছে অযথা আবদার কিংবা কৌশলে কিছু কামিয়ে নেওয়ার ফন্দি ফিকির থেকে বিরত থাকি, তাহলে সমাজের কোথাও কি তখন চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা ও দূর্নীতি খুঁজে পাওয়া যাবে?

ইসলামের এ মহান শিক্ষাটুকু আজ আমরা ভুলে অন্ধ হয়ে দৌঁড়াচ্ছি টাকা পয়সার পেছনে, নিজেরা ধনী হতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছি মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো- শহরের ইটের ফ্ল্যাটগুলোতে দিন দিন যেন বেড়ে চলেছে সম্পদলোভী কীট পতঙ্গের আবাস। জীবন বলতে তাদের কাছে শুধুই কামাই আর ভোগের সমন্বয়। এতকিছু পেয়েও কিন্তু তারা সুখী নয়।

কিন্তু কিভাবে সম্ভব আমাদের ভেতরের প্রবৃত্তিগত এ লোভ লালসা থেকে মুক্তি? খুবই সহজ। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, আপনি আপনার নীচুস্তরের মানুষদের দেখুন, ওপরতলার লোকদের থেকে দৃষ্টিকে সংযত রাখুন। এরপরও যখন আপনার চেয়ে সম্পদশালী কারো দিকে চোখ পড়ে- নিজেকে অনুভব করুন- আপনিও তো কত গরীব অসহায়ের চেয়ে ধনী, সুখে আছেন কত অসুখী মানুষের চেয়ে।

মুসলিম শরীফের হাদীস, তোমার সম্পদের হিসেবে ওপরের স্তরের কাউকে দেখো না, বরং নীচের গরিব লোকদের দিকে তাকিয়ে দেখো, নয়তো আল্লাহ পাকের নেয়ামত তোমার কাছে তুচ্ছ মনে হবে। এজন্যই প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ পাক তোমাকে যা দিয়েছেন, তা নিয়ে খুশী থাকো, দেখবে তুমিই সবার চেয়ে ধনী। (মুসনাদে আহমদ)

একটু ভেবে দেখুন তো, সম্পদের মোহে যারা অন্ধ হয়ে ভুলে যায় সব নৈতিকতা, পেছনের দেয়ালে কয়েকফুট আকারের মক্কা মদীনার বাঁধানো ছবি ঝুলিয়েও যারা মুচকি হেসে ঘুষের বিনিময়ে ফাইলে সই করে দিচ্ছেন, নামে বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকার পাহাড় গড়ছেন যারা- সত্যিই কি তারা ধনী? স্বজন ও পরিচিতজনদের কাছে তারা কি সত্যিকার অর্থেই সম্মান ও ভালোবাসার অধিকারী? নিজের পরিবার ও সন্তানদের নিয়ে কি তারা নিশ্চিন্ত ও সুখী হয়ে দিন কাটাচ্ছে?

আল্লাহ পাক তার প্রিয় রাসুলকে (সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, ‘যাদের আমি অনেক সম্পদ দিয়ে দুনিয়ার প্রাচুর্যে ভরিয়ে রেখেছি, আপনি তাদের দিকে চোখ তুলেও তাকাবেন না, তাদের তো আমি এসব দিয়ে পরীক্ষা করছি, আপনার রবের দেওয়া রিযিকই সর্বোত্তম ও চিরস্থায়ী।’ (সূরা ত্বহা-১৩১)

আমাদের এ অশান্ত পরিবেশে চুরি-ডাকতি-দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য আইন ও বাহিনীর কোনো অভাব নেই। আধুনিক সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছেনা অনৈতিকতার লেনদেন। লোভ ও হিংসার এ অপ্রতিরোধ্য গতিকে ঠেকাতে হলে নিছক শাস্তি নয়, আজ বড় প্রয়োজন আমাদের মানসিক শুদ্ধতা ও আত্মিক চেতনা। আল্লাহভীতি ও পরকালের জবাবদিহিতা ছাড়া এর অন্য কোনো উৎস নেই। তাকওয়া ছাড়া এর নতুন কোনো তাড়না নেই, নেই বিবেকের চেয়ে বড় কোনো প্রহরী।

সবাই তো ধনী হতে চাই, সুখী হয়ে বাঁচতে চাই, কিন্তু যে পথে আমরা তা খুঁজে ফিরে ক্লান্ত হয়ে হা হুতাশ করছি, আদৌ কি তা এ পথে পাওয়া যাচ্ছে নাকি আমাদের লোভ ও স্বার্থের হানাহানি আরও বাড়ছে, তা স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন নেই।

আরব মরুর সেই উম্মী নবী (সা.) আমাদের জন্য ধনী ও সুখী হওয়ার যে সরল পথ ও পদ্ধতি দেখিয়ে দিয়েছেন, এই আধুনিক কালেরও কোনো মতবাদ বা কোনো নীতি-পদ্ধতি কিংবা পরাশক্তি কি পেরেছে এর চেয়ে সহজ ও সুন্দর কোনো সমাধান দিতে?

Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: