সামাজিক সম্পর্ক রক্ষায় ইসলামী দৃষ্টিকোণ

পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আত্মীয়তা ছাড়া অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করার ক্ষেত্রেও ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে ক্ষতি করে—এমন সব আচার-আচরণ পরিত্যাগের ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসে অত্যন্ত সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নিম্নের আয়াতে সেসব হারাম জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে, যা পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও মানবীয় মান-মর্যাদার পক্ষে ক্ষতিকর।
আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন : মুমিনরা পরস্পরের ভাই। অতএব, আপন ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি-সমঝোতা করে দাও। আর আল্লাহকে ভয় কর, যেন তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়। হে ইমানদার লোকেরা! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে অপমানসূচক ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করে; কেননা তারা তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। তেমনি কোনো নারীও অপর নারীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে না—কেননা তারাও তো তার তুলনায় ভালো হতে পারে! তোমরা পরস্পরকে কষ্ট বা দুঃখ দেবে না, পরস্পরকে খারাপ উপাধিতে ডাকবে না। ইমান গ্রহণের পর ফাসিকি অত্যন্ত নিকৃষ্ট পর্যায়ের নাম। আর যারা তওবা করে বিরত হবে না, তারাই জালেম।
হে ইমানদার লোকেরা, তোমরা অনেক ধরনের ভিত্তিহীন ধারণা থেকে দূরে থাক। কোনো কোনো ভিত্তিহীন ধারণা সুস্পষ্ট গোনাহ; আর তোমরা লোকদের দোষত্রুটির খোঁজ করবে না, কেউ যেন কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ প্রচার না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? তোমরা তো তা ঘৃণাই কর। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চিত জানিও, আল্লাহ বড়ই তওবা কবুলকারী দয়াশীল। (সুরা হুজরাত : ১০-১২)
পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, মুমিনরা ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হয়ে থাকবে। হাদিসে বলা হয়েছে : তোমরা পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষে লিপ্ত হবে না, কেউ কারও পেছনে পড়ে যাবে না, কেউ কারও দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। পারস্পরিক ক্রোধ ও অসন্তোষকে প্রশ্রয় দেবে না; বরং পারস্পরিকভাবে আল্লাহর বান্দা ও ভাই হয়ে থাকবে। (বুখারি)
নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন : কোনো মুসলমানের পক্ষে তার ভাইকে তিনদিনের অধিক সময়ের জন্য সম্পর্কহীন করে রাখা হালাল বা জায়েজ নয়। তিনদিন অতিবাহিত হয়ে গেলে তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করা ও তাকে সালাম দেয়া কর্তব্য। যদি সে সালামের জবাব দেয়, তাহলে দু’জনই সওয়াবে শরিক হলো। আর জবাব না দিলে সে-ই গোনাহগার হবে এবং সালামদাতা সম্পর্কোচ্ছেদের গোনাহ থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে। (আবু-দাউদ)
পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কোচ্ছেদ তখনই নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধ যখন তা বৈষয়িক কোনো স্বার্থে হয় বা হিংসা-বিদ্বেষপ্রসূত হয়। কিন্তু সম্পর্ক ছিন্নকরণ ও বয়কট যদি আল্লাহ বা রাসূল (সা.)-এর নির্দেশে হয় এবং ইমানের দৃঢ়তা সাধনের জন্য হয়, তবে তা অবশ্যই নিন্দনীয় নয় বরং তা অবশ্য করণীয়। যেমন—সম্পর্কোচ্ছেদ ও বয়কটের ঘটনার কথা পাওয়া যায় তাবুক যুদ্ধের ইতিহাসে। আল্লাহর হুকুমে নবী করিম (সা.) ও তার সাহাবিরা তাবুক যুদ্ধে পেছনে পড়ে থাকা হজরত কা’আব ইবনে মালেক (রা.), মুরারা ইবনে ববি (রা.) এবং হেলাল ইবনে উমাইয়ার (রা.) সঙ্গে পঞ্চাশ দিন সম্পর্ক ছিন্ন করে রেখেছিলেন। অতঃপর সুরা তওবার ১১৮ নং আয়াতের মাধ্যমে তাদের তওবা কবুল হওয়ার ঘোষণা এলে তারা যারপরনাই আনন্দিত হন এবং রাসূলে করিম (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে মিলিত হন। এ ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর আদেশে সম্পর্ক ছিন্নের মতো নিষিদ্ধ বিষয়ও আবশ্যকীয় হয়ে যায়। কারণ এটাই ইমানের দাবি।
একইভাবে যদি কোনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব শরিয়তের বিধানাবলীর প্রতি উদাসীন হয়, যথাযথ শরিয়ত পালনকারীর প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এবং এসব বিধানাবলীর প্রতি অনুত্সাহ সৃষ্টি করে, তাহলে ইমানের দৃঢ়তার দাবি হিসেবে তাদেরও এড়িয়ে চলতে হবে। ইসলামের বিধানাবলী, আলেম-ওলামা এবং যথাযথ শরিয়ত পালনকারীদের নিয়ে যারা আচার-আচরণ, কথাবার্তায় বা লেখা-বক্তৃতায় প্রতিনিয়ত ঠাট্টা-বিদ্রূপ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন বা বিদ্বেষ প্রকাশ করেন অথবা ইসলামের কোনো বিধানকে ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় বলে বিশ্বাস করেন, তাহলে তাদের সঙ্গে সামাজিক, পেশাগত বা বন্ধুত্বের কারণে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাবধান হতে হবে। ইসলাম ধর্ম বা ধর্ম পালনকারীদের বিষয়ে তাচ্ছিল্য বা বিদ্বেষ প্রকাশ করার পরও কারও সঙ্গে বন্ধুত্বের খাতিরে বা সামাজিক বা পেশাগত কারণে সহজ-স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখা, ওঠা-বসা করার মাধ্যমে নিজের ভেতরে ইমানের সংবেদনশীলতা বিলুপ্ত হয়ে ইমানের দুর্বলতার বীজ রোপিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে এবং এই বীজ ক্রমে ইমান বিধ্বংসী মহীরুহেও পরিণত হতে পারে (নাউজুবিল্লাহ)। অতএব তথাকথিত উদারতার দোহাই দিয়ে এমন লোকের সঙ্গে ওঠা-বসা বা সম্পর্ক রাখা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে এটি উদারতা নয় বরং দ্বীনের প্রতি উদাসীনতা। সুতরাং এসব লোকের কথাবার্তা, আলোচনা, টকশো, লেখালেখি ইত্যাদির ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
নিকটাত্মীয়দের কেউ যদি এমন হন, যদি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তা ইমানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তবে সে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তবে এমন লোকের প্রতিও ব্যক্তি হিসেবে বিদ্বেষ পোষণ করা যাবে না। বরং তাদের হেদায়েতের বাণী শোনানো এবং তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য সুচিন্তিত ও হেকমতপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করতে হবে এবং তাদের হেদায়েতের জন্য খাস দিলে দোয়া করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এসব লোকের দুর্নাম করা এবং দোষ চর্চা করাও গিবতের অন্তর্ভুক্ত হবে। দ্বীনের প্রতি উদাসীন নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে এমন হেকমতপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে যেন সম্পর্ক ছিন্নও না হয়, আবার এমন গভীর সম্পর্কও না হয় যে দ্বীনের প্রতি তাদের গাফিলতি নিজের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে যায়। ষ
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, জ.বি. হাফেজ, মাওলানা
Prayer Times For 6 Million Cities Worldwide
Country: